রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

তামাকের ভয়াবহতা ঠেকাতে শক্তিশালী আইন কেন অপরিহার্য

ইকবাল মাসুদ
প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

T

তামাক ব্যবহার আজ বিশ্বব্যাপী এক নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর তামাক ব্যবহার জনিত কারণে কমপক্ষে ৮০ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন এবং প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ মানুষ তামাকজনিত পঙ্গুত্ববরণ করেন। বর্তমানে দেশে ১৫ লাখ মানুষ তামাক-সম্পর্কিত রোগে ভুগছেন। এছাড়া ১৫ বছরের নিচে ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। 


বিজ্ঞাপন


টোব্যাকো অ্যাটলাসের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকে মৃত্যুবরণ করেন। এসব তথ্য স্পষ্ট করে যে তামাক আমাদের জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য কতটা মারাত্মক হুমকি।

তামাকের স্বাস্থ্যগত ক্ষতির পাশাপাশি এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাবও ভয়াবহ। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্যানুসারে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, অথচ তামাক-জনিত রোগের চিকিৎসা খরচ এবং পরিবেশগত ক্ষতি মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা। 

টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০২৫ জানায়, তামাকজনিত বার্ষিক ক্ষতি প্রায় ৩৯.২ হাজার কোটি টাকা। পরিবেশের দিক থেকেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ শতাংশ বন উজাড়ের পেছনে দায়ী তামাক চাষ। এসব বিবেচনায় তামাকমুক্ত সুস্থ জাতি গঠনে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এখন সময়ের দাবি।

এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) নির্দেশনার আলোকে অনেকদিন ধরেই দেশের তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো ‘ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন’টি শক্তিশালীকরণের প্রস্তাব দিয়ে আসছে। তাদের প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হলো তরুণ প্রজন্মকে তামাকের আসক্তি থেকে রক্ষা করা, অধূমপায়ী নারী–শিশুকে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা দেওয়া এবং সামগ্রিকভাবে তামাকের ব্যবহার কমানো। 


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনীতে যে ছয়টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- পাবলিক প্লেসে ধূমপানের নির্দিষ্ট স্থান রাখার বিধান বাতিল, বিক্রয়স্থলে তামাকের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম (সিএসআর) বন্ধ, প্যাকেটে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি, খোলা ও খুচরা তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং ই-সিগারেট, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট থেকে তরুণদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ও নিকোটিন পাউচের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার দাবি। 

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে এবং জনস্বার্থের দাবি বিবেচনায় আইনটির সংশোধনী খসড়া চূড়ান্ত করেছে, যা বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের রিভিউ কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই খসড়ায় তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর জনবান্ধব প্রস্তাবনা প্রতিফলিত হওয়া সরকারের দূরদর্শী অবস্থানকে স্পষ্ট করে। ইতোমধ্যে সংশোধনীটির প্রতি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, গবেষক, রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাপক সমর্থন পাওয়া গেছে, যা সংশোধনীটির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে।

অন্যদিকে তামাক কোম্পানি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বিভিন্ন কৌশলে আইন সংশোধনের বিরোধিতা করছে। নানা বাধা সৃষ্টি করলেও মনে রাখতে হবে, প্রতিটি বিলম্ব আরও বহু মানুষের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

সুতরাং বৃহত্তর জনস্বার্থে প্রস্তাবিত সংশোধনীটি দ্রুত পাস করে কার্যকর করা জরুরি। আইনটি শক্তিশালী করা গেলে যেমন অধূমপায়ী মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবেন, তেমনি আগামী প্রজন্মের তামাক পণ্যের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। পাশাপাশি তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যুহার হ্রাস পেয়ে জনস্বাস্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে সুরক্ষিত হবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে শক্তিশালী করার এটাই সবচেয়ে আদর্শ সময়। এখন বিলম্ব করলে তামাকজনিত অকালমৃত্যুর মিছিলে আরও নাম যুক্ত হবে, পরিবার ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা আমাদের কোনোভাবেই কাম্য নয়।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর