সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নিত্য-নতুন আবিষ্কারের কারণে মানব সমাজ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজে যত নতুন আবিষ্কার, প্রযুক্তি বা যন্ত্রের উদ্ভাবন হোক না কেন তার মাধ্যমে মানব সমাজের মূলভিত্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। কারণ, জীবন চালানোর জন্য, সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য আমাদেরকে যন্ত্র নয় বরং মতবাদের ওপর নির্ভর করতে হয়।
মতবাদকে কেন্দ্র করেই সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল বিষয়গুলো প্রবর্তিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, পুজিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রসহ বিভিন্ন মতবাদ, ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রাচীন সভ্যতার মূল্যবোধ ও রীতি-নীতিকে মূলভিত্তি ধরে আজ পৃথিবীর সকল আইন রচিত হচ্ছে বা ভবিষ্যতে হবে। এ আইন ও রীতি-নীতি হলো প্রত্যেক সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। কারণ, যন্ত্র বা প্রযুক্তি ছাড়া মানুষ চলতে পারে। কিন্তু, আইন ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র টিকতে পারে না।
বিজ্ঞাপন
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আপনি যদি আফ্রিকার সুদানের কোনো অনুন্নত অঞ্চলে যান এবং সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শ ছাড়া বাঁচতে চান তাও আপনি আপনার জীবন সুন্দরভাবেই কাটাতে পারবেন। অন্তত বেঁচে থাকতে পারবেন।
কিন্তু, আপনি যদি এমন স্থানে যান যেখানে প্রযুক্তি আছে, কিন্তু আইন নেই সেখানে আপনি বাঁচতে পারবেন না। উদাহরণ স্বরূপ আমি শুধু আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে স্মরণ করতে পারি। সে দেশের নাম ভারত। কারণ, এখানে যদি উগ্রবাদী গো-রক্ষকরা এটা জানতে পারে আপনি গরুর গোশত খান। তাহলে আপনি জীবন নিয়ে ফিরতে পারবেন না। আপনাকে হয় পিটিয়ে অথবা পুড়িয়ে মারা হবে। কোন মানুষ কি খাবে ওই সংক্রান্ত আইন ভারতের কথিত ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে আছে। কিন্তু, শুধুমাত্র তার প্রয়োগ না থাকায় সাধারণ মানুষকে মরতে হচ্ছে। গরুর গোশতের বিষয়ে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, এতেই হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে ভারতে। এ কারণে বলা হয় যে আইন যদি না থাকত তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ দাঙ্গা, ফ্যাসাদ ও হানাহানিতে লিপ্ত হতো। ইজ্জত-সম্মান, সম্পদ ও জীবনের কোনো নিশ্চয়তা থাকত না। কোনো ব্যক্তিকে মেরে ফেললে কেউ বাঁচাতে আসত না। কারণ, আইন না থাকার কারণে ওই সমাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনীই থাকত না। এর মানে হচ্ছে এটা হতো একটি অরাজক সমাজ বা রাষ্ট্র।
এ কারণে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন তার বহুল আলোচিত ও বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশনস’-এ বলেছিলেন, ‘আগামী পৃথিবীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ বা অর্থনৈতিক কারণে হবে না, বরং এর কারণ হবে সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ধর্ম।’
মনে রাখতে হবে সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ধর্ম থেকেই অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় আইন ও রীতি-নীতির উদ্ভব। এ কারণে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ধর্ম ভিন্ন হওয়ার কারণে সেখানকার আইন ও রীতি-নীতি ভিন্ন। এ ভিন্নতাই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটায়। কারণ, এসব আইন ও রীতি-নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতিও পরিচালিত হয়।
বিজ্ঞাপন
যেহেতু সভ্যতা ও ইসলাম ধর্ম আমার প্রবন্ধের আলোচনার বিষয়। তাই ইসলাম ধর্ম নিয়েও কথা বলতে চাই। এরপর ধারাবাহিকভাবে অন্য বিষয়গুলোও সংক্ষেপে বর্ণনা করব যাতে করে মূল আলোচনায় সুবিধা হয়। পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মই একমাত্র ধর্ম যার মাধ্যমে নৈতিকতা, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, আইন, রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় বিষয়সহ সকল সমস্যার যৌক্তিক সমাধান আছে। মানবজীবনের এমন কোনো প্রসঙ্গ নেই যা নিয়ে ইসলাম আলোচনা করেনি। এটা সত্যিই একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। ইসলাম ধর্মে সাম্য, ভ্রতৃত্ব ও শান্তির ডাক দেয়া হয়েছে। ধনী-গরীব, জয়ী-পরাজিত,ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীর সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকলকে মানুষ হিসেবে অন্যদের প্রতি কর্তব্য পালন করতে বলা হয়েছে। পৃথিবীর সকল মানুষই যে আল্লাহর প্রতিনিধি, মানুষ হিসেবে তার যে ব্যাপক কর্তব্য তার বিষয়ে অন্য কোনো ধর্ম এত স্পষ্ট করে বক্তব্য দেয়নি। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ইসলাম ধর্ম এমন এক সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করেছে যাতে করে সকল মানুষ প্রকৃতরূপে সুখী হতে পারে। বিশেষ করে গরীব ও দুঃখীদের বাঁচার স্বীকৃতি দিয়েছে এ ধর্ম। ইসলাম ধর্মের ব্যাপকতা এতটা বিশাল যে এটা নিয়ে এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তাই খুব সংক্ষেপে ইসলাম ধর্মের সংজ্ঞায় আমি বলতে চাই। ইসলাম ধর্ম মতে, মহান আল্লাহ সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। একমাত্র তিনিই ভালো জানেন মানুষ কোন নিয়মে জীবন চালালে তা সত্যিই সুন্দরভাবে চলবে। আর তার নিয়ম অনুসারে মানব জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং চলার নামই ইসলাম। কোনো আদর্শ বা ধর্ম আমাদের ইসলামের সাথে তুলনীয় নয়। কারণ, ইসলাম সব সময়ই অন্য যেকোনো আদর্শ বা ধর্ম থেকে বেশি শক্তিশালী, বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক।
সমাজবিজ্ঞানী ই. বি টেইলর, মন্টেস্কু ও হান্টিংটন সভ্যতার সংজ্ঞা নির্ধারণে চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যেসব অভ্যাস ও দক্ষতা লাভ করে এবং যেসব জ্ঞান ও বিশ্বাস, শিল্প, আইন, নৈতিকতাবোধ আচার-আচারণ গড়ে তোলে সেগুলোই তার সভ্যতা। সভ্যতা হচ্ছে ভৌগলিক তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের আশির্বাদ ফসল। সভ্যতা মূলত সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ।
এখন কোনো সমাজের আইন কীভাবে গড়ে উঠবে তার জন্য সেখানকার সভ্যতা ও ধর্মের গুরুত্ব আনেক। কারণ, আইন হলো নিয়মের এক পদ্ধতি যাকে নাগরিক বাধ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে এবং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকর করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া আইন বলতে সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে বোঝায়। অনেক সময় সার্বভৌম শাসকের আদেশই হলো আইন। এসব কারণে সমাজের মানুষ যে ধর্ম, সভ্যতার প্রভাবে থাকে, তার মাধ্যমে তাদের আইন সৃষ্টি হয়।
ইসলামের আইন মূলত ঐশ্বরিক যা কোরআন, হাদিসের সমন্বয়ে সৃষ্টি। এ আইনের মূল উদ্দ্যশ্য বিশ্ব মানবতার কল্যাণ। তারপরেও কোনো সমস্যা থাকলে তাতে ইজমা ও কিয়াসের বিধান আছে। ইজমা মূলত কোনো আইন বা পার্থিব সমস্যার বিষয়ে মুসলিম আলেম-ওলামাদের সম্মিলিত মতামত। আর কিয়াস হলো জন-বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে থাকার সময় কোনো ব্যক্তির স্বীয় ইসলামী জ্ঞান দ্বারা বিদ্যমান সমস্যার সমাধান।
অপরদিকে চীনের আইন, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধের ওপর আবার কনফুসিয়াসের মতবাদ, তাওবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। যেমন: চীনের প্রাচীন আধ্যাত্মিক গুরু কনফুসিয়াস পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি এমনকি এমনটাও বলেছেন যে, পিতামাতার বয়স হলে সন্তানের উচিত নয় তাদেরকে ফেলে দূরে কোথাও যাওয়া।
কনফুসিয়াসের অনেক ধারণার সাথে ইসলামের কিছু আদর্শের মিল পাওয়া যায়। এমনকি সমাজতন্ত্রের আদি রূপটি ছিল মুসলিম সাহাবী আবু জর গিফারী রা:-এর উদ্ভাবন। আবু জর গিফারীকে প্রথম ইসলামী সমাজতান্ত্রিক হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয়ে থাকে। তিনি ছিলেন হযরত মোহাম্মাদ সা:-এর সময়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে চতুর্থ বা পঞ্চম ব্যক্তি। পরে সমাজতন্ত্রের ইসলামী রূপকে বিকৃত করে বর্তমান নাস্তিক্যবাদী বিকৃত সমাজতন্ত্রের প্রচলন করেন কার্ল মার্কস। ওই সমাজতন্ত্রকে আবার পুজিবাদের সাথে সমন্বয় করে এবং চীনা মনোভাবকে প্রতিফলিত করে নতুন করে সাজানো হয়েছে। অনেক পরিবর্তনের পরেও চীনের মানুষরা এ বিষয়টির ওপর নজর রেখেছেন যেন এর মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ হয়।
মূলত, প্রাচ্যের আইন, ধর্ম ও সভ্যতার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের কল্যাণ। এমনকি বিশ্বের সকল আদর্শের লক্ষ্যই হলো মানুষের কল্যাণ করা। ওই প্রেক্ষাপটের কারণেই কনফুসীয় ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের চীনের সাথে মুসলিমদের সখ্যতা আছে।
এ ব্যাপারটাকে লক্ষ্য করে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্বের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবে মূলত চীনা সভ্যতা (অর্থনৈতিকভাবে) ও ইসলামী সভ্যতা (মতাদর্শগতভাবে)। জাপানি সভ্যতা, হিন্দু সভ্যতা ও অর্থোডক্স সভ্যতাগুলো হবে সুইং স্টেট, অর্থাৎ যেকোনো একদিকে ভিড়ে তাদের অবস্থা শক্তিশালী করবে। চীনা সভ্যতা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে নিজেদের আঞ্চলিক ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তুলবে এবং সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও পশ্চিমা শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে। হান্টিংটন ইসলামী সভ্যতাকে দেখেছেন চীনা সভ্যতার সম্ভাব্য মিত্র হিসেবে। কারণ গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা অন্যান্য জিনিস নিয়ে এই দুটো সভ্যতার বেশ কিছু মিল রয়েছে যা পশ্চিমা সভ্যতার বিপরীত আদর্শ ধারণ করে। এজন্য হান্টিংটন মনে করেন- এ দু’সভ্যতা পরবর্তীতে এক হয়ে পশ্চিমের বিরুদ্ধে কাজ করবে।
বহুল পঠিত ‘ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশনস’ গ্রন্থ আজো প্রাসঙ্গিক শুধু এ কারণে নয় যে এখনো ওই বই অনুসারেই বিশ্বের অনেক দেশ ও ঘটনাকে দেখা হয়। বরং এ কারণে বিখ্যাত যে এটা মূলত, একটি পশ্চিমা পক্ষপাতদুষ্ট একটি গ্রন্থ। হান্টিংটন সমগ্র পৃথিবীকে ৮টি (সম্ভাব্য আরো ১টি) সভ্যতায় বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো: পাশ্চাত্য সভ্যতা, সিনিক (চীনা) সভ্যতা, বুদ্ধ সভ্যতা, জাপানি সভ্যতা, হিন্দু সভ্যতা, অর্থোডক্স সভ্যতা, ল্যাটিন আমেরিকান সভ্যতা, ইসলামি সভ্যতা ও (সম্ভাব্য) আফ্রিকান সভ্যতা।
এখন প্রশ্ন হলো এতগুলো সভ্যতা থাকার পরেও কেন হান্টিংটন ইসলামী সভ্যতা ও চীনা সভ্যতাকে পরস্পরের মিত্র মনে করেছেন। এ প্রশ্নের নানান উত্তর আছে। যেমন : চীন ও মুসলিম বিশ্ব ভৌগোলিকভাবে পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান করেছ এবং উভয় সভ্যতার মূল ভিত্তি বা উৎস হলো এশিয়া। সুদূর অতীত থেকেই এ দু’সভ্যতার মধ্যে সিল্ক রুটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যোগসূত্র ছিল। এছাড়া একটা হাদিসে বলা আছে, বিদ্যা শিক্ষার জন্য দরকার হলে সুদূর চীন দেশে যাও। যদিও মুসলিম পণ্ডিতরা মনে করেন এটা অন্য কোনো প্রসঙ্গের ব্যাখ্যার কারণে বলা হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘ওরিয়েন্টালিমজ‘ বইয়ের লেখক এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ। তিনি তার ‘ওরিয়েন্টালিমজ‘ বইয়ে লিখেছেন, পশ্চিমারা মনে করে যে তাদের চিন্তা, দর্শন, মতবাদ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা হলো প্রাচ্যের (এ প্রাচ্য সভ্যতার মধ্যে ইসলামী ও চীনা সভ্যতাও আছে) থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। প্রাচ্যের লোকেরা হলো অধম, মূর্খ ও বর্বর। এ কারণে পশ্চিমাদের জন্মগত অধিকার হচ্ছে প্রাচ্যের লোকদের শাসন করার ও সভ্য করার। তারা মনে করে যে প্রাচ্যের মতাদর্শ যারা অনুসরণ করে তারা হলো পশ্চিমাদের দাস। একমাত্র পশ্চিমাদেরই অধিকার আছে প্রাচ্যসহ অন্যান্য সভ্যতার লোকদের শাসন করার।
এসব কারণেই তারা ইসলামী ও চীনা সভ্যতার লোকদের শত্রু মনে করে। এখন পশ্চিমা সভ্যতা সমগ্র বিশ্বকেই নিজেদের ভাবধারা অনুযায়ী চলাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রচলন, আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ, আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ, সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক অস্ত্র উৎপাদন ও তার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বেশি ভূমিকা পালন, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কিংবা মহাশূন্য নিয়ন্ত্রণ- সবকিছুতেই পাশ্চাত্য সভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ সর্বগ্রাসী পশ্চিমা শক্তি তাই ধরেই নিয়েছে যে প্রাচ্যের মতাদর্শ অনুসরণকারীরা তাদের সাধের সম্রাজ্য ধ্বংস করে দিবে। এক্ষেত্রে প্রাচ্যের মতাদর্শ অনুসরণকারীরা পরস্পরের মধ্যে মৈত্রী গড়বে। এ কারণে তারা ইসলামী ও চীনা সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে। আর সত্যি কথা বলতে কি চীন যদি তাদের বিশ্বব্যাপী সম্রাজ্য গড়তে চায় সেক্ষেত্রে তাকে মিত্র হিসেবে মুসলিম বিশ্বক্বে প্রয়োজন হবে। আবার মুসলিমরা যদি বিশ্বে নিজেদের শক্তি বাড়াতে চায় এবং ক্ষমতার অংশীদার হতে বা শাসক হতে চায় তবে তাদেরকেও উদীয়মান সহায়ক শক্তি হিসেবে চীনকে দরকার। পশ্চিমারা ইসলামী ও চীনা সভ্যতার অনুসারীকে গোলাম আর নিজেদের মালিক বলে মনে করে। এ কারণেই গোলাম ও মালিকের মধ্যে সুসম্পর্ক কখনোই সম্ভব নয়। আবার ইসলামী ও চীনা সভ্যতার অনুসারীরা ভালোভাবেই পশ্চিমাদের সম্পর্কে জানে, তাই তাদের পক্ষে আলাদাভাবে নয় বরং ঐক্যবদ্ধ লড়াই জরুরি। কারণ, বিশ্ব রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা মিত্র নেই। রাজনীতির মানে হলো মিত্রকে শত্রু এবং শত্রুকে মিত্রতে পরিণত করা। এ বিষয়টা যারা বুঝেন না তাদের রাজনীতি করার দরকার আছে বলে মনে করি না। রাজনীতি মানে হলো ‘প্রয়োগবাদ’ ও বাস্তবতাকে অনুসরণ করা। এ কারণে দেখা যায় যে পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরান ইসলামী চেতনা ধারণ করলেও চীনের মিত্র হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করছে।
যদিও চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা জিনজিয়াং (শিনচিয়াং) প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের অত্যাচার করছে, তাদের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন করছে এবং তাদের স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। কিন্তু, কেন চীনারা হুই মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করে না। কারণ, উইঘুররা স্বাধীনতা চান, হুইদের ওই আগ্রহ নেই। এখন উইঘুর মুসলিমরা যদি স্বাধীনতার দাবি ত্যাগ করে তবে তাদের ওপর আর অত্যাচার হবে না। এর মানে হচ্ছে চীনের মুসলিম নিপীড়নের বিষয়টি মূলত ধর্মীয় হিংসা-বিদ্বেষ নয় বরং রাজনৈতিক বিষয়। মূলত, পশ্চিমা শক্তিগুলোই জিনজিয়াং (শিনচিয়াং) প্রদেশের এ স্বাধীনতার দাবিকে জোরালো করে তাদের বিবৃতি ও মিডিয়ার দ্বারা। এর মূল উদ্দেশ্য পশ্চিমাবিরোধী শক্তি চীনকে ঘায়েল করা, তার অঙ্গহানি করা। অপরদিকে স্বাধীনতার যে বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবি সেটা ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ, মানুষ কখনই স্বাধীন থাকতে পারে না। কারণ, তাকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। ইসলাম অনুসারে প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, তারা আলাদা নয় বরং একতাবদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ সীসা ঠালা প্রাচীরের মতো। এমনকি অমুসলিমদেরকে বলা হয়েছে মুসলিম রাজ্যে বাস করলে তাদের জিজিয়া কর দিতে হবে, যাতে তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে নিশ্চিত করা যায়। এ অমুসলিমদেরও কিন্তু সমাজ থেকে আলাদা বা স্বাধীন থাকার অনুমতি নেই। অনেকে মনে করতে পারেন জিজিয়া একটি নিপীড়নমূলক কর। অথচ তারা এটা বুঝে না যে মুসলিমদেরও জাকাত দিতে হয়। মূলত, রাষ্ট্র জনগনের কর বা জাকাত ছাড়া তার দায়িত্ব পালনের অর্থ যোগাড় করতে পারে না। রাষ্ট্র চালাতে ট্যাক্স বা কর লাগবেই, তা সে আধুনিক হোক বা ইসলামী রাষ্ট্র হোক।
এখন কথা হচ্ছে স্বাধীনতা কি? স্বাধীনতা হলো মানুষের অধিকার ও সুশাসন নিশ্চিত করা। অপরদিকে পশ্চিমাদের স্বাধীনতার ধারণা হচ্ছে বংশ-গোষ্ঠী, আদর্শ, অর্থনীতি, ভাষা, বর্ণ ও ভৌগোলিকভাবে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা। এর মানে হচ্ছে মানব জাতিকে বিভিন্নভাগে ভাগ করা। যাতে করে পুঁজিবাদী, ইহুদি ও ইলুমিনাতির আদর্শিক সন্তানরা বিশ্বকে শাসন করতে পারে। এ নীতিকে বলে ভাগ করো এবং শাসন কর। মানব জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, যুদ্ধ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই এ নীতির লক্ষ্য। যাতে করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা যায়। অপরদিকে ইসলাম বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রের ধারণা দেয়, ইসলামের লক্ষ্য হলো মানুষের অধিকার ও সুশাসন নিশ্চিত করা। তাই ইসলামী মতবাদ অনুসারে, আমরা উইঘুর মুসলিমদের অধিকার ও সুশাসনের নিশ্চয়তা চাই। তাদের স্বাধীনতা চাই না।
অপরদিকে ঐতিহাসিকভাবেই পশ্চিমাদের ইসলাম বিদ্বেষ হলো ধর্মীয় বিষয়। কারণ, বহুবার পশ্চিমা শক্তিগুলো ক্রুসেডের নামে মুসলিমদের পবিত্র স্থান বায়তুল মুকাদ্দাস ও জেরুসালেম শহর দখল করতে চেয়েছে। এমনকি ইসরায়েল সৃষ্টিও করা হয়েছে ওই ভয়ঙ্কর ইসলাম বিদ্বেষের কারণে। এসব কারণে পশ্চিমাবিরোধী চীন ও রাশিয়াকে নিয়ে মুসলিমদের জোট গঠনের প্রবণতা বাড়ছে।
এমইউ

