ভারতে যখন যে দল ক্ষমতা থাকে, তারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে সরকারে দেখতে পছন্দ করে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে ভারত বাংলাদেশকে যেকোনোভাবে ব্যবহার করতে পারে। এমনভাবে ব্যবহার করতে পারে বাৎসায়ন রচিত কামসূত্রের ‘৬৪ কলা’ এবং ‘৮ শৃঙ্গার’ ফেল মারবে।
আওয়ামী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ভালো। অনেকটা ‘স্বামী-স্ত্রীর মতো’। ‘স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটির মতো টুকটাক মতানৈক্য থাকলে মিটেও যায়।’ বিশাল ভারতকে তো বাংলাদেশ একথা বলতে পারে না, ‘তুমি স্ত্রী, আমি স্বামী!’
বিজ্ঞাপন
অতএব প্রাকৃতিক কারণেই আওয়ামী আমলে বাংলাদেশ স্ত্রীর ভূমিকা পালন করে। ভারত বাংলাদেশকে কামরসে সিক্ত করে, বাংলাদেশ গর্ভধারণ করে এবং যা জন্মায় তা ভারতের কোলে তুলে নেয়। বাংলাদেশ তো ভারতকে দেওয়ার জন্যই।
শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, ‘আমার দেওয়ার অভ্যাস বেশি।’ তিনি বলেছেন, ভারতকে সন্তুষ্ট করার জন্য যা যা করার এবং যা যা দেওয়ার সবই দিয়েছেন। উদারচিত্তে তিনি তা স্বীকারও করেছেন।
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারাজীবন মনে রাখবে।’ দিলে তো মনে রাখবে, তার ওপর সেই দেওয়া যদি বিনামূল্যে হয়। বিপদে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদেরকে এখন যাচাইবাছাই করে বের করতে হচ্ছে যে, আওয়ামী আমলে স্বামীরূপী ভারত তার স্ত্রী বাংলাদেশকে কী দিয়েছে এবং বাংলাদেশ তার স্বামী ভারতকে কীভাবে পরিতৃপ্ত করেছে!
বাংলাদেশ ভারতের কাছে কিছু পাক না পাক, বাংলাদেশের পক্ষে আওয়ামী লীগ ভারতকে পরিতৃপ্ত করার পুরস্কার করার সুবিধা ঠিকই পায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক। ভোটে নির্বাচিত হোক, অথবা ফ্যাসিবাদী কায়দায় ক্ষমতায় টিকে থাকুক। ভারতে বিজেপি, কংগ্রেস, কোয়ালিশন- যেমন সরকার থাকুক না কেন, অজ্ঞাত কারণে তারা সবাই বাংলাদেশের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগকে দেখতেই স্বস্তিবোধ করে।
বিজ্ঞাপন
কী অদ্ভুত! তারা আইসিটিতে মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে ভারত সীমান্তে পেয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে কারাগারে আটকে রাখে; বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকেও একই কারণে আট বছর কারারুদ্ধ রাখে। কিন্তু হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের শত শত নেতা ভিসা ছাড়া ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে ভারত তাদের ‘অতিথি দেব ভব’ বা ‘অতিথি দেবতূল্য’ বিবেচনায় আশ্রয় দেয়।
দাসত্ব ও দালালির পুরস্কার তো আছেই। আওয়ামী দেশপ্রেমের নমুনা হলো, তাদের কোনো অপকর্মে দেশে পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে গেছে, তারা আগপাছ না ভেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের দেশপ্রেম ভারতের সঙ্গে হৃদয় ও শরীরের নিবিড় সম্পর্কের মতো। দেশের প্রতি তেমন নয়।
এ প্রসঙ্গে ভারতে মোগলদের অবক্ষয়ের যুগে ১৭৩৯ সালে ‘দিল্লি লুণ্ঠনকারী’ হিসেবে খ্যাত পারস্য শাসক নাদির শাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনা মনে পড়ে। মোগল বাহিনী তখন আর অজেয় ছিল না। এ সময় ভারতে অভিযান চালান নাদির শাহ। ভারত দখল নয়, ভারতের সম্পদ লুন্ঠন ছিল তার উদ্দেশ্য। দিল্লির কাছে কর্নালে এক যুদ্ধে তার বাহিনীর হাতে মোগল বাহিনী পরাজিত হলে মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা নাদির শাহের কাছে দূত পাঠান। দিল্লি আক্রমণ না করার শর্তে বিপুল সম্পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মোগলরা প্রতিশ্রুত সম্পদ পরিশোধে টালবাহানা শুরু করে। দিল্লির ব্যবসায়ীরা পারসিক বাহিনীর কাছে রসদ বিক্রয় বন্ধ করে দেয়। এমনকি তাদের ওপর হামলা চালিয়ে কয়েকজন ইরানি হত্যা করে। নাদির শাহর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। হিন্দুস্থানিদের প্রতারণা ও বিরূপ আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি তার বাহিনীকে নির্দেশ দেন দিল্লিতে ধ্বংসলীলা চালাতে ও যত সম্পদ পাওয়া যায় তা লুণ্ঠন করতে।
আরও পড়ুন: রাজনীতিতে পলায়ন ও পলায়নের রাজনীতি
রাতে তিনি লালকেল্লায় মোগল দরবারে মোহাম্মদ শাহের সঙ্গে প্রমোদ উপভোগ করেন। এরপর শয়ন কক্ষে গেলে তাকে সেবা দিতে কক্ষে আগমন ঘটে এক সদ্য যৌবনা সুন্দরী তরুণীর। তার নাম নূর বাঈ। নাদির শাহ তাকে উপভোগ করেন এবং সন্তুষ্ট হয়ে তাকে প্রচুর উপহার দেন। যে কদিন তিনি দিল্লি অবস্থান করেন, নূর বাঈ তার দেহ ও হৃদয় দিয়ে পারস্য সম্রাটকে অকাতর সেবা দানে কুণ্ঠিত হয়নি। প্রতিবার চরম পরিতৃপ্তি লাভ করে সম্রাট উপঢৌকনে নূর বাঈয়ের নগ্ন দেহ ঢেকে দিয়েছেন। মোগল সম্রাটের প্রতিশ্রুত সম্পদ আদায় করা ছাড়াও কৌশলে বিখ্যাত হীরক ‘কোহিনূর’ এবং বহুমূল্যের ‘ময়ূর সিংহাসন’ হাতিয়ে নিয়ে নাদির শাহ দিল্লি ত্যাগের প্রস্তুতির সময় তরুণী নূর বাঈকে প্রস্তাব দেন তার সঙ্গে পারস্যে যেতে। তরুণী দৃঢ়তার সঙ্গে প্রবল ক্ষমতাধর পারস্য শাসককে বলে যে, মহামহিম যতদিন দিল্লিতে থাকবেন ততদিন সে তার সর্বস্ব দিয়ে তাকে সেবা করবে। কিন্তু সম্রাট যদি তাকে দিল্লি থেকে নিয়ে যেতে চান তাহলে সে বিষপানে আত্মহত্যা করবে।
মহান পারস্য সম্রাট শুধু তার দেহ নিয়ে যেতে পারবেন। নাদির শাহ উপলব্ধি করেন ‘একটি নারীদেহে যদি হৃদয়ই না থাকে, তাহলে সে দেহের কি মূল্য থাকে!’ হতে পারে যে, এটা পুরোটাই কল্পিত কাহিনি। তা সত্ত্বেও এ কাহিনি থেকে ধারণা করা করা যায়, পুরুষের সম্ভোগের জন্য গড়ে তোলা বেশ্যাতূল্য এক তরুণীর মাঝে যে দেশপ্রেম দেখানো হয়েছে, এতটুকু দেশপ্রেমও যদি আমাদের কোনো রাজনীতিবিদের মাঝে থাকতো, তাহলে ‘এই দেশ আমার বাবার দেশ!’ ‘এই দেশ আমার দেশ!’ ‘আওয়ামী লীগের দেশ!’ …এমন বাগাড়ম্বরের কোনো প্রয়োজন পড়ত না? আওয়ামী লীগের মাঝে দম্ভ সৃষ্টি হয়েছিল, কেউ তাদের ক্ষমতা থেকে হটাতে পারবে না। ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতা হারানোর ভয় থাকা উচিত। যদি না থাকে তাহলে ক্ষমতাসীনরা জালিম হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগও জালিম হয়ে উঠেছিল। তরুণ হিন্দি কবি শুভম শ্যাম লিখেছেন: ‘হুকুমাত কো হারনে কা খৌফ না রাহে, বরনা দেশ মে খৌফ কি হুকুমাত হো জায়েগি, বিকনে ওয়ালে কো ফানকার কাহেঙ্গে লোগ ইয়াহা, দেশ লুটনে ওয়ালে কো সরকার কাহেঙ্গে লোগ ইয়াহা, জিসনে খামোশি সে উমর লাগা দি দেশ কি সেবা মে, হক্ক কো বাত কারেগা তো গাদ্দার কাহেঙ্গে লোগ ইয়াহা।’ বাংলা অর্থ: ‘সরকারের মাঝে যদি হেরে যাওয়ার ভয় না থাকে, তা হলে দেশে ভীতির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। যারা বাজারে বিক্রয়যোগ্য, মানুষ তাদের শিল্পী বলে যারা দেশ লুণ্ঠন করে মানুষ তাদের সরকার বলে যারা মুখ বুজে সারাজীবন দেশের সেবা করেছে, সত্যের পক্ষে বললে মানুষ তাদের বিশ্বাসঘাতক বলে।’
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রখ্যাত সাংবাদিক

