জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের ওপর জেএফকে বিমানবন্দর নিউইয়র্কে যুবলীগের ডিম হামলা, অপরদিকে ডিম হামলার প্রতিবাদ সমাবেশে ঢাকার শাহবাগে বক্তব্য দিতে গিয়ে এনসিপি নেতার জয়বাংলা স্লোগান- দেশের মানুষকে রীতিমত ভাবনায় ফেলেছে। কারণ ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষ যা প্রত্যাশা করেছিল তার শতভাগ ব্যর্থ হওয়ায় দেশ গভীর সংকটে নিপতিত। বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক চিত্রে একদিকে সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলার নজিরবিহীন অবোন্নতি অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতা এবং ক্ষমতার মসনদবাসীর দ্বিচারিতা প্রকটভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। রাজনীতিক আখতার হোসেনের ওপর নিউইয়র্কে যুবলীগের ডিম হামলার ঘটনা শুধু গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতাই নয়, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সহিংস চরিত্রকেও সামনে এনেছে। অথচ সেই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে এনসিপির এক নেতার মুখে শোনা গেল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। তাহলে দাঁড়ালো এই যে, যারা আখতার হোসেনের ওপর আক্রমণ করলো তারাই আবার দেশের মাটিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। কী বিচিত্র চিত্র! কী হাস্যকর! কত হতাশার! আহারে এই নেতাদের ডাকে রাজপথে আন্দোলনে নেমে ২০২৪ সালে ঝরে গেল কত প্রাণ! আহারে! ছোট শিশুদের কতো তাজা রক্তের স্রোত বয়ে গেল বাংলার শহরে-গ্রামে!! এনসিপির এই ধরনের দ্বিচারিতা, মোনাফেকি এবং সর্বৈবভাবে দ্বৈত অবস্থান জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে এবং এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
নিউইয়র্কে আখতার হোসেনের ওপর ডিম হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিভাজন প্রবল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা, হামলা-পাল্টা হামলা একাধিকবার ঘটেছে। ডিম হামলা প্রমাণ করেছে, দেশের রাজনৈতিক সহিংসতা প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিবাদ হতেই পারে, কিন্তু ডিম ছোড়া বা শারীরিক আক্রমণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে। তাহলে এমন ঘটনা কেন ঘটল? মাত্র এক বছর যেতে না যেতেই কেন জুলাই অভুত্থানের নেতৃবৃন্দের প্রতি মানুষের এত আস্থাহীনতা তৈরি হলো? বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও তারা খুবই সামান্য ভোট পাচ্ছেন। কারণ কী? এসব বিষয়ের একটি পর্যালোচনা দরকার। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, জুলাই যোদ্ধা নেতৃবৃন্দের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই তাদেরকে জনবিমুখ করে ফেলেছে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘জুলাই যোদ্ধা’ শব্দবন্ধটি এসেছে এক রক্তাক্ত ও অশান্ত সময়কে ঘিরে। ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসেন বা নেতৃত্ব দেন, তাদের প্রথমে অনেকেই পরিবর্তনের দূত হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিল। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিল-এরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুঃশাসন ভেঙে একটি সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্র গড়বেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সময়ের সাথে সাথে সেই জুলাই যোদ্ধা নেতৃবৃন্দই নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন। তাদের সিদ্ধান্ত, কার্যকলাপ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও জনবিরোধী নীতি জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বার বার আর্থিক কেলেংকারির খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। তাদের ওপর সওয়ার হয়ে বাংলাদেশের দুর্নীতির সূতিকাগার প্রশাসন ক্যাডার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। পদোন্নতি, ডিসি নিয়োগ, এসিল্যান্ড নিয়োগসহ রাষ্ট্রের সর্বত্র আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির মচ্ছব চলছে। এই ক্ষেত্রে যারা অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা সৎ, দুদকের মাধ্যমে মূলত তাদেরই ফাঁসানো হচ্ছে। আর সবকিছু জায়েজ হচ্ছে যখন এনসিপিকে সন্তুষ্ট রাখতে পারছে। জুলাই অভ্যুত্থান ও জনআশা এখন বিপরীত মুখি অবস্থানে। জুলাইয়ের সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনমনে এক ধরণের পরিবর্তনের স্বপ্ন জেগেছিল। মানুষ ভেবেছিল: স্বৈরতন্ত্র ভেঙে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরে আসবে, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ হবে, রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেই আশার পুরোটাই ম্লান হয়ে যায় এনসিপিরি নেতাদের কর্মকাণ্ডে।
তাদের এই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মূল কারণ এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব- জুলাই যোদ্ধা নেতারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও অপারপর পুরাতন রাজনৈতিক দলের [যারা সর্বস্ব দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে] সাথে ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। কে নেতৃত্বে থাকবেন, কার অবস্থান শক্ত হবে এসব প্রশ্ন তো আছেই সাথে সাথে এনসিপির নেতৃবৃন্দ মনে করেন জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন শুধু তাদেরই অবদান। এই সব নানাবিধ প্রশ্নে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এতে সাধারণ মানুষ মনে করতে শুরু করেছে যে, এরা জনগণের স্বার্থে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থে লড়ছে।
আরেকটি বৃহৎ কারণ হলো- দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। প্রথম দিকে দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধিকরণের নামে অভিযান চালানো হলেও পরে দেখা যায়, নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ঠিকাদারি ও ব্যবসায়িক সুবিধা ভাগাভাগি হয়েছে। সরকারি তহবিল থেকে অপব্যয় বেড়েছে। মানুষ হতাশ হয়ে বলে, পূর্বের শাসক আর বর্তমান; দুজনের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ধীরে ধীরে জনগণ দেখছে যে, এই সরকার মূলত এনজিওভিত্তিক চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরকার।
বিজ্ঞাপন
এভাবে জনআস্থায় চিড় ধরে। অব্যাহতভাবে এইসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফলে জনগণের প্রত্যাশা ভেঙে যায়। শহর কিংবা গ্রামীণ জনপদে সর্বত্র মানুষ এখন বলে, আগের মতোই চলছে, শুধু মুখ পাল্টেছে। আগের মতোই তরুণ প্রজন্ম হতাশ হয়ে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও অনিশ্চয়তার কারণে দ্বিধাগ্রস্ত।
সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মিডিয়ায় জুলাই যোদ্ধা নেতাদের কর্মকাণ্ড যৌক্তিকভাবে বারবার সমালোচিত হয়েছে। সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ফলে জনমনে নেতাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এভাবেই জনবিমুখ হলেন জুলাই যোদ্ধা নেতারা। কারণ এই নেতাদের মাঝে জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দলে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা তাদেরকে জনবিমুখ করেছে। এছাড়াও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উপেক্ষা। বিদেশি স্বার্থের কাছে নতি স্বীকারের অভিযোগ প্রবল। আবার দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিয়ে অব্যাহতভাবে বিষোদগার করার কারণেও এনসিপিকে অনেক ক্ষেত্রে জনঘৃণায় পরিণত করেছে।
শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশ: উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা
আখতার হোসেনের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা, প্রবাসীদের নিরাপত্তার প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি, আওয়ামী লীগের সহিংস রাজনীতির প্রতিবাদ জানানো। মানুষ ভেবেছিল, এই সমাবেশ হবে স্বাধীন ও সাহসী প্রতিবাদের মঞ্চ। কিন্তু সেই মঞ্চেই এনসিপি নেতার জয়বাংলা স্লোগান: বিতর্কের সূচনা করে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাঝে। সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে এনসিপির এক নেতা 'জয়বাংলা' স্লোগান দেন। যা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান হলেও বর্তমান সময়ে এটি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতীক। ফলে সমাবেশের উদ্দেশ্য বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে। এতে এনসিপির দ্বিচারিতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। মানুষ মনে করে সারা দেশের আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন তারা। অথচ ১ বছর আগে এরাই আওয়ামী লীগকে বিতাড়িত করে জাতীয় বীরে পরিণত হন। এনসিপি নিজেকে স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফলে নিজেদের অবস্থান দুর্বল করছে। এতে জনমনে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সমাবেশে জয়বাংলা স্লোগান উচ্চারণ সাধারণ মানুষ ইতিবাচকভাবে নেয়নি। এমনকি এটাকে ভুল হিসেবেও নিতে চায়নি। বরং এনসিপি যে আওয়ামী লীগের ত্রাতা; এই স্লোগানের মাধ্যমে তাই প্রমাণিত হয়েছে। কেউ বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সহিংসতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আবার আওয়ামী লীগের স্লোগান?’ অনেকে মনে করেছেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এনসিপি মূলত মোনাফেকি করছে। আসলে তারা আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষা করছে।
জুলাই যোদ্ধা নেতৃবৃন্দ প্রথমে জনতার চোখে মুক্তির প্রতীক ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই জনমনে আস্থা নষ্ট করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- যে নেতৃত্ব জনগণের আস্থা হারায়, সে নেতৃত্ব টিকতে পারে না। অতএব এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, জুলাই যোদ্ধা নেতৃবৃন্দের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই তাদেরকে জনবিমুখ করে ফেলেছে; আর এ কারণেই আজ তারা রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক

