রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ডাকসু: জনগণের ক্ষমতা বুঝে নেওয়ার নির্বাচন

মুসতাক আহমদ
প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ডাকসু: জনগণের ক্ষমতা বুঝে নেওয়ার নির্বাচন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খানের সর্বশেষ মন্তব্যে মনে হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন জমে উঠেছে। যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই হয় নির্বাচন ‘বন্ধ’ নতুবা ‘ফলাফল প্রভাবিত’ করার চক্রান্ত দানা বাঁধছে। তাই তিনি ‘সবকিছু প্রকাশ করে’ সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটানোর হুমকি দিয়ে রাখলেন। এটা অবশ্য জাতির জন্য একটা সুখবর। এভাবে সাহসীরা এগিয়ে এলে বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের দ্বিতীয় মুক্তি ভূলুণ্ঠিত করতে পারবে না কোনো সম্মিলিত অপশক্তি।

সাংবাদিকতা পেশায় এই ডিসেম্বরে আমার সিকি শতাব্দী পূর্ণ হবে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে হাতেখড়ি। এই দীর্ঘ পেশাগত জীবনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেটেছে একটানা সাড়ে ৭ বছর। আবার ২০০৮ সালের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাম্পাস রিপোর্টিং ছাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু আমাকে ছাড়েনি। নানান সংকট ও বড় ইভেন্ট আমাকে ক্যাম্পাস টেনে নিয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে কাজের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখাটা পেশাগত দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল।


বিজ্ঞাপন


ব্যক্তিগত প্রসঙ্গটা সামনে আনার উদ্দেশ্য এই কথা বলার জন্য যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটির অনেক কিছুর সাথেই আমার গভীর সখ্যতা রয়েছে।ক্যাম্পাসের এমন কোনো অলিগলি নেই যেখানে আমার বিচরণ ছিল না। ২০০২ সালের শামসুন্নাহার হল ট্রাজেডি, ২০০৪ সালের টার্মিনাল ডিগ্রির আন্দোলন, ২৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও ২৭তম বিসিএসের মূল ফল বাতিল আন্দোলন, ২০০৭ সালের আগস্ট ও সেনাসমর্থিত সরকারবিরোধী আন্দোলন, কোটাসংস্কার আন্দোলনসহ আর যেসব আন্দোলন হয়েছে তার সবকিছুর সঙ্গে আছে নিবিড় সম্পর্ক। ২০০৭ সালের আগস্টে আন্দোলনের সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ছিলাম। পদের কারণে হোক আর আন্দোলনে ভূমিকার কারণে হোক, আন্দোলনের পর সেনাবাহিনীর ক্যাম্পাসে দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশের দফতরে আমাকে সপ্তাহে দু’দিন করে হাজিরা দিতে হতো। সেই কাহিনি কোনো একদিন প্রকাশের ইচ্ছা আছে, আজ নয়। সর্বশেষ যে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, সেটিও কাভার করেছি।

সবমিলে স্বাভাবিকভাবেই গত সিকি শতাব্দীতে বাংলাদেশে যত রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে, বিশেষ করে ছাত্রআন্দোলন, সেগুলো কাছ থেকে দেখা ও গভীরে ঢোকার সুযোগ হয়েছে। সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে এখানে উপাচার্যের ‘সব প্রকাশের’ হুমকির নিহিতার্থ পর্যালোচনা করার চেষ্টা করব, যাতে দেশের এই ক্রান্তিকালে ভালকিছুর প্রত্যাশা তৈরি হয়।

শুরু করব একটি ইংরেজি কথা দিয়ে। এর লেখক কে সেটা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তবে লেখক এটা ব্যবসা ও পরিবেশদূষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন তার প্রবন্ধে। কথাটি হচ্ছে: “Big businesses often profit from environmentally harmful practices, particularly in contexts lacking regulation or public awareness, while strong regulation and awareness can favor environmentally responsible business.”

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে যদি এক একটা ব্যবসায়িক কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে নির্দ্বিধায় এই কথাটিকে তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রয়োগ করা যায়। স্বাধীনতার পর গত সাড়ে ৫ দশকে আমরা সেটাই দেখে আসছি। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার বা পানি ঘোলা করে মাছ শিকার নামক ‘সিদ্ধি’ অর্জনই থাকে বেশিরভাগ পার্টির মূল লক্ষ্য। অতীতে বিশেষ করে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের তিনটি জাতীয় নির্বাচনে সরকারগুলো কমবেশি সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের চেষ্টা করায় জনগণ তাদের রায়ের প্রতিফলন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না হলেও অনেকটা দেখেছে। কিন্তু সরকারি যন্ত্রকে যখন কায়েমি স্বার্থ ও বিদেশি ষড়যন্ত্র বা দলীয় এজেন্ডার সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়, তখন সেই সরকার আর জনগণের থাকে না। ২০০৮ থেকে যে কয়টা জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে তাই ঘটেছে। আমরা সেসব বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও বলতে পারি, জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগে যে রাষ্ট্রযন্ত্র আর সরকার থাকে, তারা উদাসীন বা জনগণের বিপক্ষে থাকলে তখন যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে জনগণকে আত্মাহুতি দিতে হয়; নতুবা দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে অধিকার আদায় করে নিতে হয়। আর এই প্রক্রিয়ায় যেসব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, সেটার নামই হয়ে যায় ‘জুলাই বিপ্লব’, ‘আরব বসন্ত’ ইত্যাদি।


বিজ্ঞাপন


দুই সহস্রাধিক মানুষের জীবন আর হাজার হাজার আহত মানুষের রক্ত-হাত-পা-মাথার খুলি-চোখ-নাক-মুখের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত ‘সাময়িক’ সরকার জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছে। সেই মহারণের আগে আরেকটি ‘প্রক্সি-রণ’ এই ডাকসু নির্বাচন। এবারের এই নির্বাচনের গুরুত্ব জাতীয় জীবনে অপরিসীম। এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের প্রকৃতি ও রেজাল্টে কতটা জনমতের প্রতিফলন ঘটে, কোনো অনিয়ম করা হলে সেটা হজম করতে পারা ইত্যাদির ওপর বাংলাদেশের জনগণের আগামী ফেব্রুয়ারিতে (যদি নির্বাচন হয়) ক্ষমতায়িত হওয়া বা নিজের পছন্দমতো নেতা বা প্রতিনিধি বেছে নেওয়াটা অনেকটাই নির্ভর করবে।

যেহেতু বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও পরিস্থিতি জড়িত, তাই দেশকে বিপথে ঠেলে দেওয়া বা নিয়ে যাওয়া কুশীলবদের কাছে সবসময়ের বড় থ্রেট এই প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান আমলের নানান আন্দোলন, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী দশ বছরের সংগ্রাম, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং সর্বশেষ ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগারও যে এই প্রতিষ্ঠান, সেটা কারও অজানা নয়। আর এসব কারণেই সামনের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নজির স্থাপনের সুযোগ এসেছে। জাতীয় প্রয়োজনেই তাই ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া জরুরি।

এই নির্বাচন দেশের জনগণ ও বাংলাদেশবিরোধী দেশি-বিদেশি শত্রুদের মাঝে কী বার্তা দিতে পারে, সেটা আরও বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে ডাকসুতে ভোটের চ্যালেঞ্জ বা সুষ্ঠু ভোটের শত্রুমিত্র, ভরসাস্থল ও ভোটারদের করণীয় ইত্যাদি আলোচনা করতে চাই। 

চলবে...

লেখক: সাংবাদিক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর