সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ: কর্মীর মানসিক প্রেষণা ও কর্ম উদ্দীপ্ততার প্রয়াস

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৫, ১২:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

নারীর বঞ্চনা: বাল্যবিবাহ, তালাক ও সামাজিক সুরক্ষা

দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠানসমূহ বাণিজ্য, অ-বাণিজ্যিক কিংবা সেবামূলক। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে এবং সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্জনের মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক সফলতা। সমাজসেবা অধিদপ্তর একটি জাতিগঠনমূলক ও বহুমুখী সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। সমাজের অসহায়, বিপন্ন ও নিগৃহীত মানুষের সেবার প্রত্যয় নিয়ে এ দপ্তরের উদ্ভব। এ অধিদপ্তরকে বলা হয় বিপন্ন মানুষের ঠিকানা। মানুষের সুরক্ষা, কল্যাণ ও উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে এ দপ্তরের কার্যক্রম। এ দপ্তরের মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির শক্তি ও সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার সুনিশ্চিত করা। সমাজের একজন অসহায় ব্যক্তিকে সক্ষম করে গড়ে তোলা। যাতে সে সমাজে পূর্ণমাত্রায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। মানুষ হিসেবে ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাও এ দপ্তরের অন্যতম লক্ষ্য। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এ দপ্তর দেশব্যাপী অর্ধ শতাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সমাজকল্যাণের তরে বৃহৎ কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করছে এ দপ্তর। সরকারের বিবিধ কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে এ দপ্তর সমগ্র দেশে ১২ হাজার কর্মী বাহিনী নিয়োজিত। যারা সরকারের পক্ষে মানবিক কর্ম সম্পাদন করছে। মানবিক সেবা প্রদানে লিপ্ত সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মীদেরও প্রয়োজন মানসিক প্রেষণা ও কর্ম উদ্দীপনামূলক শক্তি। বর্তমান সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রেষণার লক্ষ্যে ‘সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ’ প্রদান করছে।

6


বিজ্ঞাপন


প্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের মানসিক প্রেষণা প্রদানের প্রচলন ছিল শিল্প অঞ্চলে। এ ধরনের উদ্যোগ শৈশব ও কৈশোরে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। শিল্প অঞ্চল খ্যাত গাজীপুর জেলায় বসবাসের সুবাদে। এ জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টুরি লি. (বিএমটিএফ) হচ্ছে এককালীন দেশের বৃহত্তম ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে আমার বড় দুলাভাই কর্মরত ছিলেন। এ সূত্রে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে বসবাসরত বোনের কাছেই লালিত হই। কৈশোর বয়সে প্রত্যক্ষ করি শ্রমিকদের মানসিক চাপ কমানো ও প্রেষণা প্রদানের কৌশলসমূহ। যেমন: প্রাতিষ্ঠানভিত্তিক বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন, বার্ষিক পিকনিক আয়োজন, শ্রমিকদের সন্তানের জন্য বৃত্তি, জাতীয় দিবস পালন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ বিশেষ মর্যাদায় পালন করা ইত্যাদি। তাছাড়া কারখানা প্রাঙ্গণে হাসপাতাল স্থাপন ও বিদ্যালয় স্থাপন ইত্যাদির ব্যবস্থা। এ সব উদ্যোগ ও আয়োজনের মূল লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক/কর্মচারীদের প্রেষণা প্রদান করা। যাতে কর্মরত কর্মীদের মাঝে পূর্ণ কর্মশক্তি বিরাজ করে। বিএমটিএফ সংলগ্ন প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যেমন: সমরাস্ত্র কারখানা, টাকশাল, ডিজেল প্লান্ট, ডুয়েট ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর একই ধরনের আয়োজন অনুষ্ঠিত হতো। বিশেষত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহে হাজির হতেন দেশের খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী ও অভিনেতাগণ। আজ পেশাগত জীবনে উপলব্ধি করছি, ঐসব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রেষণা প্রদান করা।

7

একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণশক্তি হচ্ছে কর্মরত জনবল। যা মানব সম্পদ হিসেবে গণ্য। এ মানব সম্পদকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠান তার কর্মসূচি ও কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠান সমূহ সক্রিয় জনশক্তির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। বর্তমান বিশ্বে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের জনবলকে সুশৃঙ্খলভাবে চালিত করা। অর্থাৎ মানব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য হাসিল করা। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার বহুমুখী পদক্ষেপ আছে। যার মধ্যে অন্যতম কর্মীদের প্রেষণা প্রদান। কর্মীদের আর্থিক ও অনার্থিক প্রেষণা প্রদানের মাধ্যমে কর্মীদলকে সক্রিয় ও সন্তুষ্ট রাখা হয়। যার মূল লক্ষ্য বিদ্যমান জনবল হতে সর্বোচ্চ কর্মশক্তি আদায় করা।

মানুষ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মে বাঁচতে পারে না। মানুষকে বাঁচতে হয় জীবিকা নির্বাহের মধ্য দিয়ে। কর্ম উদ্দীপ্ত মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে। কর্ম প্রয়াসীগণ কর্মের তাড়নায় পরবর্তী সকলের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু কর্মহীন বা প্রত্যাশাহীন মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না। তার অস্বাভাবিক, হতাশাগ্রস্ত ও জীবন যাপনে উদাসীন থাকে। পেশাগত জীবনে এরূপ উদাসীনতা কর্মক্ষেত্রে  ব্যর্থতার শামিল। মানসিক প্রেষণা কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্তার সহিত কর্ম সম্পাদনে মানসিক শক্তির জোগান দেয়। মানুষের প্রত্যাশাই হচ্ছে কর্ম উদ্দীপক। যা কর্মীদের কর্মে উৎসাহিত করে। স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাব কাজের প্রতি কর্মীর আগ্রহ বৃদ্ধি করে। প্রেষণা একটি মানসিক প্রক্রিয়া। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদল কীরূপ উদ্দীপনা পেতে পছন্দ করে, তার উপর নির্ভর করেই কর্মীদেরকে উদ্দীপকের জোগান দিতে হবে। মনে রাখতে হবে একজন উদ্দীপ্ত কর্মীই সন্তুষ্ট কর্মী। সন্তুষ্ট কর্মীই একটি প্রতিষ্ঠানকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।


বিজ্ঞাপন


8

বর্তমান জনপ্রশাসনে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ দপ্তরের কর্মরত সহকর্মীদের এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে ধাবিত করতে হয়। যাতে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন সফল হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন কর্মী প্রেষণা। প্রতিষ্ঠানের জনশক্তিকে কর্মে প্রেরিত করার বিষয়ে প্রথম ধারণা প্রদান করেন প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আব্রাহাম হ্যারল্ড মাসলো। তিনি ১৯৪৩ সালে psycho-logical Review নামক একটি পত্রিকায় A Theory of Human Motivation নামক একটি প্রবন্ধ লিখেন। এ প্রবন্ধে প্রেষণা সম্পর্কে একটি মতবাদ ব্যক্ত করেন যা চাহিদা সোপান তত্ত্ব নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এ তত্ত্বে বলা হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ তাদের অভ্যন্তরীণ বা অন্তর্নিহিত অভাব পূরণের  জন্য কর্মে নিয়োজিত হয়। মানুষের অভাব আছে বলেই সে পরিশ্রম করে এবং উপার্জন করে। প্রেষণার মূলভিত্তি হচ্ছে প্রয়োজন ও অভাবকে অনুভব করা। মাসলো মানুষের অভাবগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা জৈবিক প্রয়োজন, নিরাপত্তা প্রয়োজন, সামাজিক প্রয়োজন, আত্মতৃপ্তি প্রয়োজন ও আত্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম ধাপ হচ্ছে পেষণা (Motivation)। প্রেষণা হচ্ছে কর্মীদলকে উদ্দীপ্ত করার একটি প্রক্রিয়া । যাহার তিনটি উপাদান বিদ্যমান যথা প্রয়োজন (Needs), তাড়না (Drives) ও লক্ষ্য (Goals)। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দপ্তর পরিচালনায় কর্মীদলকে মোটিভেটেড করার সুনির্দিষ্ট কৌশল থাকা আবশ্যক। দাপ্তরিক লক্ষ অর্জন ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বিধানে প্রেষণার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যথা: প্রেষণা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক, কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করে, দক্ষতা বৃদ্ধি করে, সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করে, কর্মে গতিশীলতা আনায়ন করে ও কর্মসন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক।

9

দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের প্রত্যেক দপ্তরকে সক্ষম জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যাতে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য হাসিল হয়। এ ক্ষেত্রে দপ্তরসমূহ সক্ষমতা বিবেচনায় প্রেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রেষণা প্রদানে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করতে হয়। যেমন: মনস্তাত্ত্বিক বিষয়, অনুপ্রেরণা, প্রয়োজন, আর্থিক ও অনার্থিক উদ্দীপনা ও ব্যবস্থাপনার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। মনাব সম্পদ প্রেষণার কৌশল অবস্থার প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাধারণত কর্মীদের আর্থিক ও অনার্থিকভাবে প্রেষণা প্রদান করা যায়। আর্থিক প্রেষণা প্রদানের কৌশলসমূহ হচ্ছে: উচ্চতর বেতন প্রদান, পদোন্নতির সুযোগ, বোনাস, বাসস্থান সুবিধা, পরিবহন সুবিধা, চিকিৎসাসুবিধা ও পুরস্কার ইত্যাদি। অনার্থিক প্রেষণার কৌশলসমূহ হচ্ছে: প্রতিশ্রুতি, কর্মের নিরাপত্তা, পদোন্নতির সুযোগ, প্রশিক্ষণ সুবিধা, কর্মের স্বীকৃতি, সৃজনশীলতায় উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি।

10

সম্প্রতি সরকারি দপ্তর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মানসিক প্রেষণা প্রদানে উদ্যোগী হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর চলতি বর্ষে সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছে। কক্সবাজার  সমুদ্র সৈকতের মনোরম ও প্রাকৃতিক পরিবেশে এরূপ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। যার লক্ষ্য সকল স্তরের কর্মীগণকে মানসিক ভাবে অনুপ্রাণিত করা। মানুষ কোনো যন্ত্র নয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে প্রত্যেক কর্মী এক অনন্য শক্তির আধাঁর। দপ্তরের প্রত্যেক কর্মী তার পূর্ণশক্তি সহকারে দায়িত্ব পালন করুক। সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে দপ্তরকে সমৃদ্ধ করুক। প্রত্যেক দপ্তর প্রশাসক  বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্মী প্রেষণায় ব্রতী হোক। শোভন কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি এবং কর্ম উদ্দীপ্ততার প্রচেষ্টা হোক দাপ্তরিক অঙ্গীকার।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর