যুদ্ধের অভিঘাত অর্থনীতির শিরায় ছড়িয়ে পড়ে, বাজারকে টলিয়ে দেয়, কূটনীতির ভারসাম্য নড়িয়ে দেয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ক্রমেই যে রূপ নিচ্ছে, তা কেবল দুই দেশের নয়-এর পরিধি বিস্তৃত হয়ে পড়ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। আর সেই কম্পন এসে লাগছে বাংলাদেশের দোরগোড়ায়ও। ইরান-ইসরায়েলের দহনে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে বারুদের গন্ধ যখন ঘন হচ্ছে, তখন তার ছায়া পড়ছে আমাদের কর্মজীবী প্রবাসীদের মাথায়, পেট্রোল পাম্পের ডিজেলে, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে। ঝড় কখনো শুধু আকাশে হয় না। ঝড় নামে বাজারে, মুদ্রার মূল্যে, কূটনৈতিক শিবিরে-ঝড় নামে জনমনে। যুদ্ধ যদি শুধু গোলা-বারুদের খেলা হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশ এখনো দূরে নিরাপদ থাকত। কিন্তু আজকের বিশ্বে যুদ্ধ শুধু রণক্ষেত্রে নয়, যুদ্ধ হয় বাণিজ্যপথে, রেমিট্যান্সে, খাদ্য সরবরাহে, এমনকি জাতিসংঘের প্রস্তাবনাতেও।
এই যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব না থাকলেও, পরোক্ষ প্রভাব অনেক গভীর। প্রবাসী আয়ের ওপর চাপ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় ও মুদ্রা সংকট-সবই বাস্তব সম্ভাবনা। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, আগাম প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সাবলীল সক্রিয়তা। কারণ, এই সময় চুপ করে থাকা মানেই সুযোগ হারানো, কিংবা বিপদকে অবহেলা করা। এই বৈশ্বিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে। ঝড় আসবেই-কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে ভেসে যেতে হয় না। সামনে শুধু পরমাণু নয়, সামনে রয়েছে প্রতীকী যুদ্ধও-নিরপেক্ষতা বনাম পক্ষগহণ, কূটনৈতিক ভারসাম্য বনাম বৈশ্বিক চাপ। তাই প্রস্তুতি চাই এখনই, ঝড় আসার আগে- Not after the first lightning. কারণ, ঢেউ তো লাগবেই। কিন্তু আমরা কি শুধু গা ভাসাব, না কি ঢেউ ঠেকাতে বাঁধ দেবো আগেই? বিশ্ব যখন উত্তপ্ত, তখন নিস্পৃহ থাকা নয়-বরং তাতে সূক্ষ্ম, কৌশলী, সময়োচিত সক্রিয়তা প্রয়োজন। সামনে বাংলাদেশ কেমন বিপদের মূখে পরতে পারে তাই নিয়ে এই লেখায় আলোকপাত করতে চাই।
বিজ্ঞাপন
জ্বালানি নিরাপত্তা: বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি ও জাতীয় অর্থনীতির টানাপোড়েন
বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। দেশের আমদানি-নির্ভর তেল সরবরাহের একটি বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, বিশেষত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল হয়ে। এই রুটে সামান্য উত্তেজনাও তেল পরিবহনে ব্যাঘাত ঘটায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে বিশ্ববাজারে তেলের দামে। যুদ্ধের তাপ ছড়িয়ে পড়লে, রপ্তানিকারক দেশগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে কিংবা রুট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে সরবরাহেই ঘাটতি তৈরি হবে। বাংলাদেশ সরকার গত কয়েক বছর ধরে জ্বালানি আমদানি বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে, রিজার্ভ কমছে, টাকার মান পড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি সেই সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। পাশাপাশি জ্বালানির দাম বাড়লে শিল্প উৎপাদন খরচ বাড়বে, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, কৃষিখাতে ডিজেল নির্ভরতায় পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হবে, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। সরকারকে এখন থেকেই কৌশলগত জ্বালানি মজুদ গড়ে তুলতে হবে, বিকল্প উৎস যেমন রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার দিকে নজর দিতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের ওপর বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

রেমিট্যান্সের নিরাপত্তা ও অভিবাসী সংকট
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবাসী রেমিট্যান্স একটি বড় অর্থনৈতিক ভরসা, যার বেশিরভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যুদ্ধ পরিস্থিতি শুধু সরাসরি ক্ষয়ক্ষতির হুমকি নয়, বরং এতে কাজ হারানো, ফেরত আসা শ্রমিকদের সামলানো এবং নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে যদি সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাত কোনোভাবে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তবে তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কঠোর হবে, শ্রমবাজার সংকুচিত হবে এবং বিদেশি কর্মীদের অগ্রাধিকার কমতে পারে। এমনকি সাময়িক নিষেধাজ্ঞা বা ভিসা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে শুধু পরিবারে অর্থনৈতিক চাপ বাড়বে না, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও হুমকির মুখে পড়বে। তাই, বিদেশে নিযুক্ত দূতাবাসগুলোকে এখনই প্রবাসীদের অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জরুরি অবস্থায় তাদের সুরক্ষা, পুনর্বাসন ও সহায়তায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে। সরকারকে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বিকল্প শ্রমবাজারের সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় যেতে হবে।
খাদ্য সরবরাহ চেইন ধস ও মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা
বাংলাদেশ অনেকাংশেই খাদ্যপণ্যের আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে গম, ভুট্টা, সয়াবিন, চিনি ইত্যাদি পণ্য আসে ইউরোপ-এশিয়া রুট ধরে, যার একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্য বা রেড সি-র ট্রানজিট ব্যবহার করে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং হুতিদের দ্বারা রেড সিতে হামলা সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটালে খাদ্যপণ্য দেশে পৌঁছাতে দেরি হবে বা দাম বাড়বে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে স্থানীয় বাজারেও চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য নষ্ট হবে। বিশেষ করে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন বিপর্যস্ত, নতুন করে যুদ্ধের প্রভাবে তা আরও প্রকট হবে। এখানে সরকারের করণীয় হলো-১) খাদ্যপণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা (যেমন-রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল), ২) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে আমদানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং ৩) স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের প্রণোদনা বৃদ্ধি ও ভর্তুকি সম্প্রসারণ।
কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা: বাংলাদেশের এক সূক্ষ্ম পথচলা
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপ্রিয় ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির ধারক। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক রাজনীতির জটিল বাস্তবতায় ‘সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ নীতিটি রক্ষা করাও হয়ে উঠেছে চ্যালেঞ্জিং। ইরান, সৌদি আরব, কাতার, তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আবার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ—যাদের সমর্থন বাংলাদেশের উন্নয়ন, বাণিজ্য এবং কূটনীতির জন্য অপরিহার্য—তারা প্রায়ই ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেয়। এই অবস্থায় যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেওয়া সহজ নয়। জাতিসংঘে বা ওআইসিতে কোনো বিবৃতি দিলে সেটি এমনভাবে দিতে হবে যাতে স্পষ্টভাবে মানবিক শান্তির পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট হয়, কিন্তু কোনো পক্ষ প্রত্যক্ষভাবে আহত না হয়। সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতার বড় পরীক্ষা।

চীন-রাশিয়ার সঙ্গে ভারসাম্য, অতিরিক্ত নির্ভরতার ফাঁদ নয়: চীন ও রাশিয়া, বিশেষত চীন, বাংলাদেশের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার। তবে বর্তমান যুদ্ধপ্রবণ বিশ্বে অতিরিক্ত কোনো পক্ষের প্রতি ঝুঁকে পড়া দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই কিছু ভোটিং বা বিবৃতির কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ও কূটনীতিতে সমালোচনার মুখে পড়েছে। কাজেই এখন বাংলাদেশকে স্মার্ট পলিসি নিতে হবে—যেখানে একদিকে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে, অন্যদিকে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিশ্বাসভাজন কূটনীতি বজায় থাকবে। নন-অ্যালাইন্ড আন্দোলনের পুরনো চেতনা নয়, বর্তমান বাস্তবতায় নমনীয় কিন্তু দৃঢ় ভারসাম্যই হওয়া উচিত বাংলাদেশের পথ।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও মানবাধিকার কূটনীতি
যুক্তরাষ্ট্র শুধু ইরান-ইসরায়েল প্রশ্নেই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও সক্রিয়। এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠবে তাদের কৌশলগত মিত্রদের পাশে টানতে। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নির্বাচনী স্বচ্ছতাকে হাতিয়ার করে তারা পরোক্ষ চাপ বাড়াতে পারে। বাংলাদেশকে তাই আন্তর্জাতিক যোগাযোগে আরও দক্ষ ও তৎপর হতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষ কূটনৈতিক নিযুক্তি, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও মিডিয়া ব্যবস্থাপনার নতুন কৌশল নেওয়া জরুরি। এখানে ‘প্রতিবাদ’ নয়, ‘প্রতিসংবাদ’-এই কৌশলটাই বেছে নিতে হবে।
গণমাধ্যমে দায়িত্বশীলতা ও জনমত ব্যবস্থাপনা
এমন সংকটকালে সংবাদমাধ্যমে দায়িত্বশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অপপ্রচার, বিভ্রান্তিমূলক ভাষ্য এবং ‘মতামতের নামে প্ররোচনা’—এই ত্রিমাত্রিক চাপে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। রাষ্ট্র যদি চুপ থাকে আর মিডিয়া যদি বেপরোয়া হয়, তাহলে বিভ্রান্ত জনমত রাষ্ট্রেরই ক্ষতি করবে। তাই দরকার তথ্যভিত্তিক সাংবাদিকতা, সরকারের নিয়মিত ব্রিফিং এবং বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে জনসচেতনতা তৈরি। এখানে সেন্সর নয়, সংলাপ জরুরি।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্য এখন কৌশলগত অপরিহার্যতা
এই সংকট আন্তর্জাতিক হলেও, তা মোকাবেলায় চাই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ন্যূনতম ঐক্য। জাতীয় স্বার্থে সরকার ও সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্তত কৌশলগত বোঝাপড়া তৈরি না হলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বক্তব্য দুর্বল হতে বাধ্য। একটি বৃহৎ সংঘাতের প্রেক্ষাপটে যদি আমরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত থাকি, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলে আমরা কতটা প্রস্তুত ও বিশ্বাসযোগ্য—সেই প্রশ্ন উঠে আসবে। তাই সময় এসেছে, জাতীয় স্বার্থে একটি পরামর্শক ফোরাম গঠনের।
শান্তি উদ্যোগে অংশগ্রহণ, সফট পাওয়ারের ব্যবহার: বাংলাদেশ যদি চায়, তাহলে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিকে ‘কূটনৈতিক সফট পাওয়ার’ বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে পারে। জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে, ওআইসির সম্মেলনে, এমনকি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক জোটগুলোতে (যেমন BIMSTEC) শান্তি-স্থাপনের পক্ষে জনমত তৈরি করে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শান্তিরক্ষী পাঠানো দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি মানবিক ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বপরিসরে পরিচিত। সেই ভাবমূর্তি ধরে রেখে, জাতিসংঘের মধ্যস্থতা উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য সম্মান ও আস্থা বাড়াবে। একইসাথে বিশ্বশান্তিতে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দৃশ্যমান হবে।
প্রস্তুতি ছাড়া রক্ষা নেই
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যতই দূরের ঘটনা মনে হোক, তার প্রতিধ্বনি বাংলাদেশে অর্থনীতি, সমাজ ও কূটনীতিতে সরাসরি বাজছে। এই প্রতিকূলতার মোকাবেলায় প্রয়োজন এখনি পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও প্রয়োগ। সরকারের উচিত এখনি: (ক) জ্বালানি ও খাদ্য খাতে বিকল্প উৎস নির্ধারণ ও কৌশলগত মজুদ গড়ে তোলা। (খ) মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রবাসীদের নিরাপত্তায় হেল্প ডেস্ক ও দূতাবাসের সক্ষমতা বৃদ্ধি। (গ) বিকল্প শ্রমবাজার ও বাণিজ্যিক রুটের সন্ধান। (ঘ) জাতিসংঘ, ওআইসি ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ফোরামে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ। (ঙ) অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণে বহুমাত্রিক যুদ্ধ ঝুঁকিকে অন্তর্ভুক্ত করা। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এমন এক ক্রসরোডে, যেখানে কেবল নিরপেক্ষ থাকার অজুহাত যথেষ্ট নয়। চাই বিচক্ষণতা, আগাম প্রস্তুতি, এবং সাহসী কূটনৈতিক কণ্ঠস্বর।
উপসংহার: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ কখন থামবে, কত দূর যাবে, বা কে কাকে সমর্থন করবে-সবই অজানা। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এই অস্থিরতা এক গভীর সতর্কবার্তা। নিরপেক্ষতা মানে চুপ করে থাকা নয়-মানে সচেতন থাকা, প্রস্তুত থাকা। এই যুদ্ধ হয়তো দূরের; কিন্তু এর অভিঘাত আমাদের খুব কাছেই এসে দাঁড়াতে পারে। তাই সময় এখনই-রাষ্ট্রকে, নেতৃত্বকে, প্রশাসনকে, আমাদের সবাইকে একসঙ্গে প্রস্তুত হতে হবে। কারণ ঝড় এলে গাছ টিকে থাকে তার শিকড় শক্ত থাকলে।
ঝড় আসবেই, তাই প্রস্তুতি চাই আগে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ কেবল সীমান্তে ঘটে না; যুদ্ধ আসে পেটের ক্ষুধায়, প্রবাসীর অনিশ্চয়তায়, বাজারে আগুনে, কূটনৈতিক চাপে। এই যুদ্ধের ঢেউ গায়ে লাগতেই পারে-কিন্তু ভেসে যাওয়ার আগে প্রয়োজন দৃঢ় নীতিনির্ধারণ, বাস্তবভিত্তিক কৌশল এবং সময়োচিত রাষ্ট্রীয় সাহস। কারণ, বিশ্ব যখন উত্তপ্ত, তখন নিরপেক্ষ থাকা মানেই কৌশলীভাবে সক্রিয় থাকা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশ এখন আর কেবল ‘পর্যবেক্ষক’ নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির ও কূটনীতির জালে আটকে থাকা এক অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র। কাজেই সংঘাত যতই দূরে ঘটুক, তার অভিঘাত যতই পরোক্ষ হোক, প্রস্তুতি না থাকলে সেটি হবে এক ভয়ংকর অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ের কারণ।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক; মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ

