সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

স্বাধীনতার প্রধান ব্যক্তিত্ব জিয়া

শওকত মাহমুদ
প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২৫, ১০:০২ এএম

শেয়ার করুন:

Shoukot Mahmud
শওকত মাহমুদ

আমরা গর্ব করে বলি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই শুধু যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। এটাই সত্য এবং এই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী ও চেতনা এখনও রাজনৈতিক ও জনজীবনে প্রধান আলোচ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের সুক্ষ্মতম ময়না তদন্ত এখনও চলছে এবং ক্ষমতার বলদর্পিতার সূত্র ধরে ইতিহাসের যথেষ্ট বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে।

আমরা মানি বা না মানি, শুনে থাকি বা না শোনার ভান করি, মেজর জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যে ঘোষণা সবাই শুনছেন। প্রথমে নিজে এবং পরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম বলেছিলেন- উই রিভোল্ট। স্বাধীনতা যুদ্ধ তিনিই সূচনা করেছিলেন। ওই যুদ্ধ বলতে মেজর জিয়াকে তার অগ্রনায়ক বুঝায়। যারা অনুপস্থিত ছিলেন, মানুষের জীবন স্মৃতির আয়নায় তা আসে না। ওই ঘোষণা এবং জিয়ার মুক্তিসংগ্রামের বাস্তব সূচনা সামগ্রিক যুদ্ধের সূচনা ঘটায়। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ব্যক্তিত্ব জিয়া আজও মানুষের মনে দেদীপ্যমান। তিনিই ছিলেন তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জ্যেষ্ঠতম বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা। বস্তুত তাঁর ওই ঘোষণা এবং যুদ্ধের আহবান গোটা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে যুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে।


বিজ্ঞাপন


মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একজন গবেষক আমাকে বলেছিলেন, ২৭ মার্চ জিয়ার ঘোষণায় যখন পাকিস্তানের ন্যায্য হবু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখ করা হল, তখন পাকিস্তানীরা বন্দী শেখ মুজিবের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। এর আগে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানা যাচ্ছিল না। শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে ঘেষণা দেয়ার কৌশলের কারণেই পাকিস্তানীরা পত্রিকায় ছবি ছেপে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে আছেন।

হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এক মরণজয়ী ইতিহাস। সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে জিয়া রণাঙ্গণেই সার্বক্ষণিক সক্রিয় ছিলেন। তাঁর যুদ্ধকালীন সহকর্মীরা নানা লেখায় জিয়ার বীরত্বকে তুলে ধরেছেন। দখলদার বাহিনীর মাঝে জিয়ার নামটি ছিল আতংকের। জিযার স্বাধীনতা-ঘোষণা ও যুদ্ধকালীন সক্রিয়তার জন্য হানাদার বাহিনী জিয়ার পরিবারকে বন্দী করে রেখেছিল। অপরদিকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পরিবার ছিল পাকিস্তানীদের মেহমানদারিতে।

বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের যে অহমবোধ তাকে বাঁচাতে বিদেশীদের বিরুদ্ধে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭ তে বাঙালি মুসলমান সৈন্য অধ্যুষিত বেঙ্গল ল্যান্সার্স ইউনিটের সিপাহী বিদ্রোহ, '৬৫র খেমকারানে জিয়ার নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং '৭১এ চূড়ান্ত স্বাধীনতার মরণপণ সংগ্রাম-এ সবের নানা ওঠা-পড়া, নানা এগোনো-পিছানোর মাঝ দিয়ে উতরে আসার ধারাপাতই আমাদের ইতিহাস। আর তাঁর মধ্যমণি শহীদ জিয়া। '৭১ এর অনিশ্চিত-অনির্দেশ্য সময়ে দেশবাসীর কানে বেজেছিল তাঁর কণ্ঠস্বর, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা আমি মেজর জিয়া বলছি। আর কেউ তা পারেনি বলে তিনি সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে গেছেন অনেক উচ্চতায়। পরম শ্রদ্ধেয় আমাদের জাতীয় কবি নজরুল যেন এমন এক চরিত্রের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর সেই আকুতি "অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ। কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।

কিন্তু কাণ্ডারী জিয়া কি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই নিঃশেষ হয়ে গেলেন? না! তারপর পাঁচ, সাড়ে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ঘটনার আবর্তে আবার এলেন তিনি। এবং এসে তিনি শুরু করেন এক আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণ কাজ। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে নিজের ব্যক্তিচিন্তা ও কর্মের প্রভাব সঞ্চারে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। বর্জনবাদী, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসিকতাসম্পন্ন স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর ছিল না। বরং তাঁর রাজনৈতিক কর্ম বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রহণবাদী, একমোডেটিভ মানসিকতা ছিল তাঁর। এর ফলে অতি বাম, অতি ডান গোষ্ঠীর সকলে তাঁর দলে এসে ঠাঁই পেয়েছে এবং নতুন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তাঁর সেই কাজের প্রভাব আজো সমাজে দৃশ্যমান। তাঁর জীবনকালে যারা বিরুদ্ধবাদী ছিল, পরে তারা বিএনপিতে এসেছে এবং শহীদ জিয়াকে তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মি বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে একথা সত্য। এখানেই শহীদ জিয়ার প্রভাবের চিত্রটা উপলব্ধি করা যায়।


বিজ্ঞাপন


স্মরণ করলে দেখা যাবে, অস্ত্র আর গুলির মুহুর্মুহু নিনাদের মধ্যে নেতা হিসাবে এসে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের কাণ্ডারী হয়ে রাষ্ট্রকে দ্রুত এক সুস্থির কাঠামোতে দাঁড় করালেন। একদলীয় শাসনের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বদলে মিশ্র অর্থনীতি, একদলীয় শাসনের বিপরীতে বহুদলীয় গণতন্ত্র উপহার দিলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডাকে মূলমন্ত্র রেখে গঠিত হল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এরপরের ইতিহাস হচ্ছে এক সচেতন কাণ্ডারীর হাতে বাংলাদেশের একটি সংবিধান সম্মত আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের নিয়ামক হচ্ছে দেশের জনতা এবং নেতা হিসাবে নির্মাতা হচ্ছেন জিয়া। ১৯৬৫ থেকে ধরলে আজ অবধি জিয়াউর রহমান এই নামটি ক্রমে জনমানুষের চিন্তা চেতনায় আলোড়িত হয়ে চলেছে।

জিয়া যে চিরায়ত স্বাধীনতা সংগ্রামী, তার ব্যাখ্যায় বলব বাংলাদেশের রাষ্ট্র নেতা হিসাবে তাঁকে শুধু প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেখা যাবে না। সমাজ জীবন যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন, মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা যখন বেড়াজালে আবদ্ধ, আর্থিক জীবন বিধ্বস্ত, শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত.

লোকসমাজের মনোজগৎ এবং চেতনা ও মনন লক্ষ্যভ্রষ্ট, সর্বোপরি রাজনৈতিক জীবন বিপন্ন তখন জিয়া আসেন রাষ্ট্রে রাজনীতির মধ্যমঞ্চে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত ছিল নাৎসীবাদের শ্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশে ফ্যাসীবাদের ইতিহাস। এক নেতা এক দেশ- এই শ্লোগানটি ছিল হিটলারের নাৎসী দলের। ভারতের সু-সাহিত্যিক অন্নদা শঙ্কর রায়ের একটি মন্তব্য উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি (১৯৯৬) বলেছিলেন, "ফ্যাসিবাদ ও নাৎসীবাদ দুটোই এখন পরাজিত। কিন্তু কতক লোক এখনও ফ্যাসিজমের অনুরক্ত। তারা তা ফিরিয়ে আনতে চায় বা প্রবর্তন করতে চায়। ফ্যাসিজম হচ্ছে এমন এক মতবাদ, যার রাজনৈতিক দিকটা ছিল সংবিধান।

লেখক: সাংবাদিক, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও মহাসচিব; জনতা পার্টি বাংলাদেশ।

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর