সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চা শ্রমিক নারীদের অধিকারের লড়াই: এক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

জান্নাতুল বাকিয়া জেনি
প্রকাশিত: ২২ মে ২০২৫, ০৪:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

চা শ্রমিক নারীদের অধিকারের লড়াই: এক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আধুনিক নগরজীবনে আমাদের অনেকেই বিকালের সময় কাটাই শহরের ব্যস্ত রাস্তায় চায়ের দোকান কিংবা ঝকঝকে কফি শপে। এক কাপ চা কিংবা কফির মাঝে আমরা প্রবেশ করি নানা ভাবনার জগতে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, এই প্রতিদিনের স্বস্তির পেছনে যাদের কঠোর শ্রম, তাদের জীবন কেমন? বিশেষত সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের চা বাগানে কর্মরত নারী শ্রমিকদের গল্পগুলো কেমন?

বাংলাদেশের চা শিল্পে বর্তমানে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক শ্রমিক নিয়োজিত, যাদের একটি বৃহৎ অংশ নারী। এ নারীরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও তাদের শ্রম, মর্যাদা এবং অধিকার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোর মধ্যে উপেক্ষিত থেকে গেছে। তাদের মজুরি অত্যন্ত সীমিত, কর্মপরিবেশ অনিরাপদ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও তারা প্রায় বঞ্চিত। তাদের অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জনের সংগ্রামও অনেক পুরনো।


বিজ্ঞাপন


সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিস্থিতিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নিপীড়ন হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়; বরং এটি লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি ও ক্ষমতার সম্পর্কের জটিল আন্তঃসম্পর্ক দ্বারা গঠিত এক বহুস্তরীয় নিপীড়নের চিত্র। কার্ল মার্ক্সের শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্ব অনুযায়ী, চা শ্রমিক নারীরা উৎপাদনের উপকরণ থেকে বঞ্চিত নিপীড়িত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তারা শ্রম দেয়, কিন্তু উৎপাদনের ওপর তাদের কোনো মালিকানা নেই। অপরদিকে নারীবাদী তত্ত্বের আলোকে দেখা যায়, তারা দ্বিগুণ নিপীড়নের শিকার একদিকে শ্রমিক হিসেবে, অন্যদিকে নারী হিসেবে সমাজে অবমূল্যায়িত।

চা শ্রমিক নারীদের অধিকাংশই দলিত আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। পিয়েরে বুরদিয়ুর সাংস্কৃতিক পুঁজি তত্ত্ব অনুযায়ী, তারা শিক্ষা, ভাষা ও সামাজিক সংযোগের মতো সাংস্কৃতিক পুঁজির থেকে বঞ্চিত। ফলে সমাজে ঊর্ধ্বগতি (social mobility) অর্জন তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ইমানুয়েল ওয়ালারস্টেইনের বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব অনুসারে, চা শ্রমিকরা গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের 'periphery' বা প্রান্তিক অংশে অবস্থান করে, যাদের শ্রম বিশ্ববাজারে ব্যবহৃত হয়, অথচ তারা মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষায় সবচেয়ে পশ্চাৎপদ অবস্থানে রয়ে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও গভীর, কারণ নারী শ্রমকে অধিক সস্তা, কম দক্ষ ও বেশি নিয়ন্ত্রণযোগ্য হিসেবে দেখা হয়।

ফাংশনালিস্ট তত্ত্ব অনুযায়ী, সমাজের প্রতিটি অংশ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল। কিন্তু যখন রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ এই নারীদের অধিকারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই ভারসাম্য ভেঙে পড়ে এবং সমাজে বৈষম্য ও অবিচার আরও জটিল আকার ধারণ করে। বাস্তবতা হলো, চা শ্রমিক নারীরা রাষ্ট্রীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত নয় বললেই চলে, ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন কিংবা শিক্ষার সুযোগ তাদের নাগালের বাইরে থেকে যায়।

চা শ্রমিক নারীদের সমস্যা শুধুমাত্র একটি শ্রমঘটিত বিষয় নয়; এটি একটি বৃহৎ সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ইস্যু। লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণি ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই সমস্যার সমাধানে চাই বহুস্তরীয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক কৌশল। প্রয়োজন রয়েছে আইনগত সংস্কার, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন, সংগঠিত সচেতনতা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা, এবং রাষ্ট্র-কর্পোরেট-এনজিও সমন্বিত উদ্যোগ।


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ: মজুরি বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, এবং নারী শ্রমিকদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ নারীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করছে এবং তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর শ্রম অধিকার নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করছে, তাদের প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার মাধ্যমেও চা শ্রমিক নারীদের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সংগঠনসমূহ নারী শিক্ষার প্রসার, আইনি সহায়তা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই লড়াইকে শক্তিশালী করে তুলছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাগান মালিকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উচিত হবে শ্রমিকদের উপযুক্ত মজুরি প্রদান, নিরাপদ ও মানবিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসনের সুযোগ তৈরি করা এবং শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই নারীদের কেবল 'সহায়তার প্রয়োজনীয়তা' হিসেবে না দেখে তাঁদের 'ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা' হিসেবে বিবেচনা করা। তাদের কণ্ঠস্বর, অভিজ্ঞতা এবং সংগ্রামকে সম্মান জানিয়ে সমাজে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।

"চা শ্রমিক নারীর কাঁধে বোঝা ভারী,
তবু সে হাসে, স্বপ্ন তার আঁখি জুড়ায়।
চায় সে অধিকার, থাকে পথে বাধা,
একদিন আসবেই মুক্তির সেই সাধা।"

চা শ্রমিক নারীদের অধিকার আদায়ের লড়াই কঠিন হলেও তা অনিবার্য। রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, নাগরিক সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব এই প্রান্তিক নারীদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও ন্যায্য ভবিষ্যৎ নির্মাণ।

লেখক: লেকচারার, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর