১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী শীর্ষক গ্রন্থের সম্পাদকীয় ভূমিকার আরম্ভটা ছিলো এরকম—‘একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারী এমনি এক যুগান্তকারী দিন। শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারী সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের এই বিশ্ব-ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপী যে সংগ্রাম, একুশে ফেব্রুয়ারী তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে একুশের আবির্ভাব ছিলো, প্রকৃত প্রস্তাবেই, একটি যুগের সূচনা। সম্পাদকের ওই ভূমিকাংশে একুশে ফেব্রুয়ারি তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মৌল চরিত্র যেমন উন্মোচিত, তেমনি প্রকাশিত এই আন্দোলনে ভবিষ্যৎবিস্তারী প্রভাবের পূর্বাভাস। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে নতুন পথের সন্ধান, নির্মাণ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন সড়ক।
ভাষাভিত্তিক একটি জাতি হিসেবে বাঙালির ঐতিহাসিক আত্মপ্রকাশের ইতিহাসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যথার্থই একটি মহত্তম দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মজাগরণের দিন, স্বাধিকারের স্বপ্ন বপনের দিন, আপন সত্তাকে বিপুল মহিমায় ঘোষণা করার দিন, সংঘশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণের দিন। বাস্তিল দিবসে ফরাসি জাতি শত বছরের গ্লানি মুছে যেমন লাভ করেছিলো নবজন্ম, তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিলো তার আত্মপরিচয়ের নতুন ঠিকানা। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন প্রধানত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও পরিণতিতে তা জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনাউৎস হিসেবে পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা।
বিজ্ঞাপন
বায়ান্ন সালে ভাষা-আন্দোলন সফল পরিণতি লাভ করলেও, এ-আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিলো দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই। অবশ্য গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী, এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলেছে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে এ-বিতর্কের এক ধরনের মিমাংসা হয়ে যায়। ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পরিস্কার অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা।
মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে—এ-প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলো। এ সময় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। তরুণ লেখক আবদুল হক এবং মাহবুব জামাল জাহেদীও অনুরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মিল্লাত ও ইত্তেহাদ পত্রিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ এনামুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কাসেম প্রমুখ ব্যক্তি অভিন্ন দাবির সমর্থনে লেখা প্রকাশ করেন; একই দাবির পক্ষে সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে তমদ্দুন মজলিশ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসেই গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। তমুদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে, যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়।
সাতচল্লিশ সালে দেশবিভাগের পরে বাংলা ভাষা সম্পর্কে বাঙালির এই আবেগকে আমলে নিতে চায়নি মুসলিম লীগ সরকার। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের ব্যবহার্য ভাষা ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু চালাবার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি সংশোধনী প্রস্তাবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার্য ভাষা করার দাবি তোলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রূঢ় ভাষায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণপরিষদে কেবল ব্যবহার্য ভাষা নয়, ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন বলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তিরস্কৃতও হন। প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন—১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সূচিত হয় রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন। অভিন্ন দাবিতে যশোরসহ পূর্ব বাংলার নানা শহরে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এ পটভূমিতে মুহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় ঘোষণা করেন—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ ধ্বনি তুলে জিন্নাহর ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং এভাবে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন অর্জন করে নতুন মাত্রা।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫১—এই চার বছরে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন স্পষ্ট কর্মসূচির অভাবে আস্তে আস্তে থিতিয়ে পড়ে। প্রতিবছর ১১ মার্চ ভাষা-আন্দোলনের বার্ষিকী পালিত হলেও, এ-বিষয়ে তেমন কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন আবার ঘোষণা করেন—পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, থিতিয়ে পড়া রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন পায় নতুন গতি—১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে যা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে—সৃষ্টি হয় বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়, বিশ্বমানবের উজ্জ্বল এক উত্তরাধিকার।
বিজ্ঞাপন
১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনে রক্তাক্ত বিজয়ের পরেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে থামিয়ে রাখার নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে প্রকাশ্যে-গোপনে। পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহিত হয় ১৯৫৪ সালের মে মাসে, যুক্তফ্রন্টের কাছে সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে বলা হয় যে, বিশ বছর পরে এ-সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। ১৯৬২ সালে গৃহীত পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধানে আবারও বিশ বছরের অপেক্ষার পালা ঘোষিত হয়। কিন্তু বিশ বছর আর অপেক্ষা করতে হয়নি। দশ বছরের মধ্যেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে ঘোষিত হয় ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।
দুই.
ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা—সূচনা থেকে সফল পরিসমাপ্তি। এ আমরা সবাই জানি, কথাটা এক লফজে বলেও থাকি। কিন্তু যা ছিল ছাত্র-তরুণ ও শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন, তা কী করে দুই দশকের মধ্যে একটি জাতির জাগরণ ঘটিয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে নিয়ে আসে! অবশ্য মাও সে তুং বলেছিলেন বটে, স্ফুলিঙ্গ থেকেই দাবানলের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার তো একটা বিস্তৃত বহুমাত্রিক কাহিনিই থাকার কথা। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তা আজো হয়নি।
বায়ান্ন থেকে শুরু করে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, সবসময় নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র-যুবকরা। যেমন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন। আর ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তো তৈরিই হয়েছে আসাদ-মতিউরদের আত্মদানের বিনিময়ে। নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। রাজনীতিকেরা ছিলেন পেছনের সারিতে। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে যুবকদের চিত্ত আন্দোলিত করতে পেরেছিলেন, সে-ও ছাত্র-যুবকদের আকাঙ্খাকে সামনে নিয়ে আসার কারণে। যুবকরা চেয়েছিল পাঞ্জাবিদের নিগড় থেকে মুক্তি। শেখ মুজিবের ‘ভায়েরা আমার’ আহ্বানে সেই মুক্তির প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন তারা।
এই আন্দোলনকে আসলে শুধু ভাষার আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা অথবা ব্যাখ্যা করলে সেটা সঠিক হবে না। কেননা শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি আন্দোলন কীভাবে কৃষক-শ্রমিকসহ গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে পৌঁছেছিল, সে ইতিহাস তো জানা প্রয়োজন। কেবল ভাষার আন্দোলনে সম্পন্ন হয়নি, এ দেশের মূলধারার রাজনীতি এবং কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-যুবকদের বিভিন্ন সংগঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনের অবদানও তাতে কম নয়।
ভাষা আন্দোলনের কোনো একক রাজনৈতিক নেতা ও নায়ক ছিল না। জনগণই ছিলেন তার প্রকৃত নায়ক। বায়ান্নের আন্দোলন নিছক রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন ছিলো না। ততোদিনে বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করেছিলো। কারণ, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ধ্বনি দিয়ে তারা তো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের প্রত্যাশা থেকে। কৃষক ভেবেছিলো তারা জমি পাবে, শ্রমিক ভেবেছিলো কাজ পাবে ও বাঁচার মতো মজুরি পাবে, ছাত্রদের জন্য শিক্ষা হবে সুলভ, শিক্ষিত যুবকেরা পাবে চাকরি ও জীবিকার নিশ্চয়তা। ক্রমে বাঙালির অধিকার চেতনা প্রখর হয়েছে। তারা কেন্দ্রে সব ক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহর অনমনীয় মনোভাব, লিয়াকত আলীর গোঁয়ার্তুমি, পাকিস্তানের অবাঙালি আমলাদের বাঙালিবিরোধী ভূমিকা, আর অন্যান্য পাকিস্তানি ও পাকিস্তানপন্থী বাঙালি রাজনীতিকদের দোলাচল ও আপসকামিতায় প্রথমে তারা আস্থা হারায় মুসলিম লীগের ওপর। মুসলিম লীগের এই জনবিচ্ছিন্নতার কারণেই এবং মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর থেকেই অবশ্য তাঁরা সকলে প্রথমে ধীরে এবং পরে দ্রুতগতিতে উপলব্ধি করলেন যে, যে স্বপ্ন পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে তারা দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন তৎকালীন মুসলিম লীগ শাসনের দ্বারা বাস্তবে রূপায়িত হওয়া সম্ভব নয়। বাঙালি মুসলমানের এই মনোভাব পরিবর্তনের পেছনে দেশে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষাবস্থারও গুরুত্ব রয়েছে।
ভাষা আন্দোলনে সাংগঠনিকভাবে যুবলীগের ভূমিকা ছিলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ ছাত্রদের দাবি গৃহিত হওয়ার পেছনে যুবলীগের সমর্থনই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। আর এই সাহসী কাজের ফলেই সেদিন পুলিশের গুলিবর্ষণ ও পরবর্তী প্রতিরোধ পর্যন্ত ঘটনা গড়িয়েছে।
বদরুদ্দিন উমর তাঁর অভিমত স্পষ্টভাবেই তুলে ধরেছেন তাঁর একটি বইয়ে, ‘যেভাবেই দেখা যাক, এ কথা অনস্বীকার্য যে ২০শে ফেব্রুয়ারি তারিখ রাত্রি থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে কম্যুনিষ্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র ও যুবলীগ কর্মীরাই সাংগঠনিকভাবে সব দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।’
২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে ভাষার জন্য আত্মাহুতি দেন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর, বরকতসহ আরো কয়েকজন যুবক। রক্তের দামে আমরা আমাদের মাতৃভাষার অধিকার পাই। মায়ের ভাষা অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দেয় ছাত্র-যুবকরাই। ইতিহাস তাই বলছে।
তিন.
১৯৫১ সালের মার্চে গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী এই সংগঠন গড়ার পেছনে প্রধান নেপথ্য শক্তি কমিউনিস্ট পার্টি। উদ্দেশ্য ছাত্র-যুবসমাজে সুস্থ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ এবং দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে অগ্রচারী সহায়ক সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলা। ভাষা আন্দোলনকে শক্তিমান করে তোলার বিষয়টিও তাদের চিন্তায় ছিলো। তবে বিশেষ সতর্কতা ছিলো একে কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠনের বদলে উদার গণতন্ত্রী প্রগতিবাদী ধারায় সংগঠিত করা, যাতে উদার ভিন্ন চিন্তার রাজনীতিমনস্ক যুবকরাও এতে অংশ নিতে পারেন। বাস্তবে তা-ই ঘটেছিলো।
এই সংগঠন সম্পর্কে যে যেমনই বলুন, এর মিশ্র রাজনৈতিক চরিত্র সত্ত্বেও এতে ছিলো প্রগতিবাদী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রাধান্য। সংগঠনের নির্বাহী কমিটির অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযোগ্য যুবকদের রাজনৈতিক মতাদর্শিক পরিচয় থেকে এর প্রমাণ মিলবে। অবশ্য কৌশলগত কারণে তখন যুবলীগের প্রথম সভাপতি মনোনীত করা হয় রাজনৈতিক বিচারে মধ্যপন্থী মহম্মদ আলীকে।
সহ-সভাপতি হিসেবে ছিলেন সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, ইয়ার মহম্মদ খান, শামসুজ্জোহা, দৌলতুন্নেছা প্রমুখ। রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা সবাই চেনামুখ। সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মতিন ও রুহুল আমিন। সদস্যদের মধ্যে বিশিষ্টজন মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হালিম সরদার, আবদুস সামাদ, কে জি মোস্তফা, কবির আহমদ, আবদুল ওদুদ, প্রাণেশ সমাদ্দার প্রমুখ।
যুবলীগের গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী আদর্শের প্রকাশ ঘটেছিলো স্বদেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনায়, আন্তর্জাতিক পরিসরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্রে। তাই যুবলীগ যেমন ভাষা আন্দোলন সফল করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তেমনি মৌলিক অধিকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্দোলনের অংশীদার হয়েছে। যেমন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগত দাবি-দাওয়া এবং অনুরূপ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ।

ওই বছরেরই ডিসেম্বরে যে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়, তাতেও পূর্বোক্ত রাজনৈতিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। যেমন সভাপতি নওবেলাল সম্পাদক মাহমুদ আলী, সহ-সভাপতি মির্জা গোলাম হাফিজ, ফয়েজ আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, ইয়ার মোহাম্মদ খান ও শামসুজ্জোহা। সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ এবং যুগ্ম সম্পাদক ইমাদুল্লাহ ও মুহম্মদ সুলতান। কোষাধ্যক্ষ মাহবুব জামাল জাহেদী। সদস্য আবদুল মতিন, এবিএম মূসা, আবদুল হালিম সরদার, আবদুল ওদুদ, আলী আশরাফ, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুস সামাদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, প্রাণেশ সমাদ্দার প্রমুখ।
প্রধানত তারাই একুশের ভাষা আন্দোলনে মূল কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তুলেছিলেন এবং বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সফল করে তুলতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাই বলাই বাহুল্য, একুশের আন্দোলনে অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছিলো পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, যদিও এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক নাম তখন পূর্ববঙ্গ। কমিউনিস্ট পার্টি কৌশলগত কারণে পূর্ব পাকিস্তান নামটি ব্যবহার করেছিলো।
চার.
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি ঘিরে গভীর ও আবেগের প্রকাশ সত্ত্বেও সাধারণভাবে মাতৃভাষা তথা বাংলাভাষার ব্যবহারিক দিকে গভীর চর্চার ক্ষেত্রটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। সেখানে শিক্ষায়তনে ইংরেজি মাধ্যমের ব্যাপক দুর্মূল্য দাপট। এই দাপট যেমন শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমনি জীবিকার ক্ষেত্রেও। করুণমুখ বাংলাভাষা সেখানে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। তাই বাংলার ভাষিক অনুশীলন দ্রুত কমতে শুরু করেছে, সেখানে শ্রম, সময় ও আন্তরিকতার অভাবও দেখা যাচ্ছে। স্বভাবতই অবহেলার পরিণামে বাংলার শুদ্ধচর্চা, নির্ভুল বলা ও লেখার ক্ষেত্রটি ছোটো হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে যেমন প্রবণতার প্রভাব পড়ছে তেমনি পড়ছে এর বাইরে। বানান-ভুল, শব্দ ব্যবহারে ভুল, উচ্চারণে ভুল, কথকতায় বা বক্তৃতায় বা টিভির টকশোতে ইংরেজি বাংলার দোআশলা স্থূল ব্যবহার চেতনায় আঘাত করে না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা ‘স্মার্টনেস’ এর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এফএম রেডিওর স্থূল, কখনো আপত্তিকর বাংলা- ইংরেজির ব্যবহারিক প্রচার আপাত বিচারে সরস ও তির্যক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বাংলা ভাষার করুণ অবস্থারই প্রমাণ তুলে ধরে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব দেখার কেউ নেই। নিয়ন্ত্রণের কারো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। বাংলা ভাষার ব্যবহার সত্যিই এক ব্যাপক উদাসীনতার শিকার।
রাষ্ট্রভাষাকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এ বিষয়টিকে আমরা গর্ব ও অহংকারের সঙ্গে গ্রহণ করেছি। কিন্তু জাতীয় জীবনের যে ঘটনা সেটাকে আমরা সরিয়ে রেখেছি। উপনিবেশিক রাজকীয় ভাষা ইংরেজি আগে যেমন ছিল সে অবস্থানেই থেকে গেল। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালত থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার বদলে ইংরেজি ব্যবহার চালু থেকে গেলোা। বাংলা ক্রমে অবহেলিত হয়ে পড়লো এবং পিছু হটলো। বাংলা শিক্ষা এবং বাংলা ভাষা নির্ভুলভাবে বলা লেখা এবং চর্চার দিকটাতে একটা উদাসীনতা ও অবহেলা থেকেই গেল। ভাষা আন্দোলনের সেই ‘সর্বস্তরের বাংলা চালু কর’ স্লোগানটি কেবল স্লোগান হিসেবে থেকে গেলো।
পাঁচ.
বায়ান্নের পথ ধরে আজকের যুব সমাজ। বায়ান্ন থেকে যেমন যুব সমাজকে আজ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না। তেমনি আজকের যুব সমাজকে আলাদা করে এ আলোচনা শেষ করা সম্ভব নয়।
যুবকদের নিয়ে অনেকে হতাশা কিংবা সংশয় প্রকাশ করেন। হয়তো বর্ষিয়ানদের এ সংশয়ের বাস্তবতা আছে। কিন্তু বাস্তবতা সত্যি কী বলে? বাস্তবতা যা-ই হোক, সেই যুবকদের উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের দায়টাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা জরুরি। আমরা কতোটা পেরেছি তাদের জন্য একটা উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে, এগুলো ভাববার বিষয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যতো সরকার এসেছে, কেউ তরুণদের আশা-আকাঙ্খার সঙ্গে মিলিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি বিন্যস্ত করতে পারেনি। ফাঁকা স্লোগানে তাদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছে। পারেনি। কেনো পারেনি? যুবকদের সামনে কি কোনো দিশা দেখাতে পেরেছে তারা?
গত ৫০ বছরে যুবকরা কিভাবে আশা সঞ্চার করতে পারছে, সেই আলোচনা কিন্তু আড়ালে থেকে আছে। উল্টো সমালোচনা হচ্ছে। হওয়াটা স্বাভাবিক। সেই সমালোচনাকে গ্রহণ করার মানসিকতা যুব সমাজের আছে। এটাই হচ্ছে যুব সমাজের ধর্ম অথবা চারিত্রিক দৃঢ়তা। নানা কারণে যুব সমাজের হতাশার পেছনে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা দায়ী।
এ-কথাও বলতে হবে, গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে যতো আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তার পেছনে যুব সমাজই ভূমিকা রেখেছে সবচেয়ে বেশি। ব্যর্থতা যেমন আছে, সফলতার ঝুলি নিছক কম নয়। এগুলো আমাদের বেশি বেশি করে বলতে হবে। একই সঙ্গে বায়ান্ন-র ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদেরকে অনুপ্রেরণা খুঁজতে হবে।
/এএস

