যুগে যুগে অনেকেই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য ইতিহাসের পাতায় অনুকরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। অধ্যাপক মােহাম্মদ শরীফ হােসেন তাদের অন্যতম। আজ ৪ ফেব্রুয়ারি, শরীফ স্যারের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছ।
সকলের শ্রদ্ধাভাজন শরীফ স্যার ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি যশাের শহরের খড়কি পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ২ বছরের মাথায় তিনি পিতৃহারা হন। তবে এ কারণে কখনো লেখাপড়ায় অমনােযােগী হননি। বরঞ্চ তুখােড় ছাত্র ছিলেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় পরীক্ষার রেজাল্ট দেখেই। প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশান, আইএতে প্রথম বিভাগ, বিএ তে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এমএ তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার লােভনীয় প্রস্তাব পান। কিন্তু নিয়ােগ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি কৃষক সংগঠন করার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যশােরে ফিরে আসেন এবং এক সময় নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে খুলনা বিএল কলেজে অধ্যাপনা করেন। মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজ ও মাইকেল মধুসূদন কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন যেমন খ্যাতিমান, অধ্যক্ষ হিসেবে তেমনি দক্ষ শিক্ষক প্রশাসক ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
অধ্যাপক শরীফ স্যার ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে আজীবন কাজ করেছেন মানুষের জন্য। একেবারে নিঃস্বার্থভাবে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্কুলের কিশাের শরীফ হােসেন ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। আর ৫২’তে তমদ্দুন মজলিশের যশাের শাখার নেতা হিসেবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সক্রিয় নেতৃত্ব দেন। যুক্ত হন রাজনীতির সঙ্গে। যশােরে গড়ে তােলেন যুবলীগ সংগঠন। পরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন যশাের শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। এতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে তিনি ’৫৪ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন দিনরাত। এ সময় তৎকালীন সরকার পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা সংকোচনের অসৎ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কলেজ প্রাদেশিকীকরণের উদ্যোগ নিলে এর বিরােধিতা করে সংগ্রাম শুরু করেন এবং গ্রেফতার হন। সরকার মুচলেকা দিয়ে তাকে মুক্তি দিতে চাইলে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

রাজবন্দি শরীফ স্যার ১৪ মাস কারাভােগ করে মুক্তি পেলেন, চাকরিও হারালেন। তখন সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি সবজি বিক্রি করেছেন। কিন্তু অপশক্তির কাছে মাথানত করেননি। আওয়ামী লীগ ভেঙে ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হলে শরীফ স্যার তাতে যােগদান করেন এবং সাধারণ সম্পাদক (১৯৫৮) হন। তিনি ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে। ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। ইতোমধ্যে ৭ ডিসেম্বর যশাের জেলা শত্রুমুক্ত হলে বীর জনতা তাকে কারাগারের ফটক ভেঙে মুক্ত করে আনেন।
শরীফ স্যার শুধু রাজনৈতিক কর্মি বা শিক্ষাবিদ ছিলেন না। তিনি একধারে শিক্ষানুরাগী ছিলেন। যশােরে তার হাতে গড়ে ওঠে অনেক প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৩ সালে ‘রাতের সূর্য’ নামে যশােরে প্রথম নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঘােপ মাহমুদুর রহমান স্কুল, যশোর ইনস্টিটিউট স্কুল, আব্দুর রাজ্জাক কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও নিজের ৫ বিঘা জমি দান করে আঞ্জুমানে খালেকিয়া এতিমখানা, ১৯৮৭ সালে পেনশনের তিন-চতুর্থাংশ টাকা দিয়ে গড়ে তােলেন লিল্লাহ বােডিং। এটি ত্যাগের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। গরীব মেধাবী ছাত্রদের লেখাপড়ায় সহায়তা, গরীব রােগীদের চিকিৎসা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহযোগিতার জন্য উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। আর ১৯৯৪ সালে সন্দীপন নামে কিশােরী ও নারী কল্যাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সন্দীপনের মূল দর্শন— ‘আলো থেকে আলাে জ্বালাে।’ একইসঙ্গে গ্রামাঞ্চলে সন্দীপন পাঠকেন্দ্র গড়ে তোলেন। গরীব মেধাবী ছাত্রদের জন্য গ্রামাঞ্চলে কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। কীটনাশক বিহীন ফসল আবাদে গ্রাম-গঞ্জে সভা সমাবেশ ছাড়াও বাস্তবমুখী কর্মকাণ্ড শুরু করেন।
বিজ্ঞাপন
শরীফ স্যার ছিলেন গ্রন্থাগার আন্দোলনের একজন নেতা। যেখানে শিক্ষকতা করেছেন, সেখানেই বই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যশাের পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের আধুনিকীকরণ করেন। পরিণত করেন সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে। তিনি বাংলাদেশে বইমেলা ও ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি পরিসেবার প্রবর্তক। গ্রন্থাগার আন্দোলনে ভূমিকা পালন করায় ২০০২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।
শরীফ স্যার ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মাপের একজন মানুষ। অসাধারণ একজন পণ্ডিত। অথচ খুবই সাদাসিধে ও আড়ম্বরহীন জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। পীর বংশে জন্ম নিলেও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। অথচ ছিলেন ধর্মপ্রাণ। কাজের মধ্যেই সফলতা খুঁজতেন। এই কর্মবীর হােক সকলের প্রেরণার উৎস এই প্রত্যাশা।