ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে পতিত স্বৈরাচার সরকার পরিবর্তনের কারণে ২০২৪ সাল একটি বিশেষ বছর। একটি ভিন্ন পরিস্থিতি। অর্থনীতি নিয়ে আলোচনায় এ বিশেষ পরিস্থিতি মাথায় রাখতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ক্রমান্বয়ে এক দফা ও এক দাবি নিয়ে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গণআন্দোলনে রূপ লাভ করে। সংঘটিত হয় এক গণঅভ্যুত্থানের। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও শেষ রক্ষা হয়নি। সরকারের পতন ঘটে আগস্টের ৫ তারিখ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারযোগে ভারতে পালিয়ে যান। ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গড়ে তোলা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রায় দীর্ঘ ষোল বছর পর জনগণ স্বৈরাচারী সরকারের কবল থেকে মুক্ত হয়। নতুন বাংলাদেশ, নতুন স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই এখন সকলের প্রত্যাশা।
পতিত স্বৈরাচারী সরকার দেশের অর্থনীতিকে এতটাই নাজুক অবস্থায় রেখে গেছে, যার ফলে অর্থনীতির ছোট বড় সূচকগুলো বড়ই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ২০২৪ সালের উচ্চ মূল্যস্ফীতি গেড়ে বসেছিল। ওপরের দিকে উঠছে, নামার লক্ষণ নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ছিল দুর্বল। অনেক ধরনের অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ থমকে গেছে। সারা বছর ধরেই অর্থনীতি দুর্দশার মধ্যে ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দেয় ধীরগতি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ দৃশ্যমান। ব্যাংকগুলোর প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি অর্থনীতির ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে। পুঁজিবাজারে সংস্কার শুরু হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকার পরিচালন ব্যয়ে লাগাম টেনেছে। সংস্কারের ফলে আগামীতে অর্থনীতি ভালোর দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ বছরের শেষ দিকে এসে মানুষকে আশা জাগিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সরকার বদলের পর আহসান এইচ মনসুর নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি ডলারের দাম ১২০ টাকা নির্ধারণ করেন এবং তা আড়াই শতাংশ পর্যন্ত কমবেশি করার সিদ্ধান্ত দেন। এতে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে ডলারের বাজার। এদিকে প্রবাসী আয়ও বাড়ে। এতে রিজার্ভের পতন থেমেছে, এখন তা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সামনে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।
বড় আশার আলো জ্বালিয়েছে আমাদের প্রবাসী আয়। দেশে ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না অথবা কোনো দায়ও পরিশোধ করতে হয় না। রফতানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। অন্যদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেও ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশে ডলারের মজুতও দ্রুত বাড়ে।
আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রবাসী আয় বেড়েছে। প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। তবে চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৮ দিনে বৈধ তথা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ২৪২ কোটি ১০ লাখ ডলার। প্রতিদিন গড়ে এসেছে আট কোটি ৬৪ লাখ ডলার। শেষ তিন দিনসহ এই মাসে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন ব্যাংকাররা। ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা কাটছে না। চাঁদাবাজি চলছে, যদিও চাঁদাবাজ বদলের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, অর্থনীতিকে সংকটে রেখেই বিদায় নিয়েছে ২০২৪।
তবে বিদায়ী বছরের কিছু ভালো দিক রয়েছে। যেমন শ্বেতপত্রের আয়নায় অর্থনীতির করুণ চিত্র তুলে ধরা, সংস্কারের লক্ষে কমিশন গঠন, ডলার সংকট কেটে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপ, ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে পদক্ষেপ নেওয়া, যা এখনো অব্যাহত আছে। অর্থপাচার, ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগে মন্দার বিষয়গুলো আলোচনার মূল ইস্যু ছিল।
বিজ্ঞাপন
২০২৪ সালের অন্যতম বড় উদ্যোগ ছিল অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ। পদে পদে দুর্নীতির কারণে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা উঠে এসেছে প্রথমবারের মতো নেওয়া এই উদ্যোগে। সংবাদপত্রের পাতা থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, গড়ে প্রতি বছর গেছে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
দেড় দশকে সরকারি কেনাকাটা থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছেন রাজনীতিবিদ ও আমলারা। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রকল্প থেকে লুটপাট হয়েছে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। আর শেয়ারবাজার থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা।
ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাজস্ব খাত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। প্রতি মাসেই লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে ছিল এনবিআর। দেশের বড় বড় শিল্প গোষ্ঠী ও নানা অনিয়ম, অর্থ পাচার, করফাঁকির সুযোগ গ্রহণ করে। পতিত সরকার নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে সকল অনিয়মকে আশ্রয় প্রস্রয় দিয়ে গেছে। ফলে তৈরি হয়েছে বড় বড় ক্ষত। যার খেসারত জনগণকে দিতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ শিল্প গ্রুপের মধ্যে চারটি গ্রুপ নিয়ে তদন্ত শুরু করছে সিআইডি। বাকি ছয়টির তদন্ত করছে দুদক। এ তালিকায় রয়েছে বহুল আলোচিত এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, বসুন্ধরা ও শিকদার গ্রুপ। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায়, শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই সেটি থেকে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বের করে নেয়। এ অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ। এই ব্যাংক থেকে গ্রুপটির নেওয়া পরোক্ষ ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা।
নতুন বছরকে সামনে অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি করতে হলে বাংলাদেশে ডুয়িং ব্যবসা করার জন্য সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ করহার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। অর্থনীতিকে টেকসই ও গতিশীল করতে সমস্যাসমূহ পর্যায়ক্রমে দূর করতে হবে। নতুন বছরের চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হলো আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, বিনিয়োগের সহজ ও সাবলীল পরিবেশ নিশ্চিত করা, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ও পাশাপাশি রফতানি বৃদ্ধি করা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে ব্যবসা বাণিজ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে আর্থিক সচ্ছলতার পথ দেখানো সকলের প্রত্যাশা। নতুন বছরে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাই এগিয়ে আসবে যার যার অবস্থান থেকে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার