সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নতুন বন্দোবস্তে জনতার নীরবতাকে সম্মতি ভাবাটাই হবে ভুল

এস এম সৈকত
প্রকাশিত: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৮ এএম

শেয়ার করুন:

নতুন বন্দোবস্তে জনতার নীরবতাকে সম্মতি ভাবাটাই হবে ভুল

একটা সময় আমরা সবাই চুপ ছিলাম। ইচ্ছে করে নয়, কালো আইন, অপশাসনের বেড়াজালে বিপর্যস্ত না হবার শঙ্কায়। কথা বললেই হুমকি-ধামকি, লিখতে গেলে সাইবার আইনের খড়গ, আর ভিন্নমতকে সহিংসতা দিয়ে দমনের সময়টিতে জনমানুষের জবাব ছিল ‘নীরবতা’। সরব রাজনীতির মানুষেরা নিজেরাও দেশান্তরী হয়ে, গা ঢাকা দিয়ে বেড়িয়েছেন। পকেট বিরোধী পক্ষ সৃষ্টি করে, লালন পালন করে, ড্রয়িং রুম স্টাইলে মিডিয়া তৈরি করার সাথে সাথে নাগরিক সমাজেরও অল্টারনেটিভ দাঁড় করানো হয়েছিল। যে কথা বলবে সেও নিজের লোক, যে ছাপাবে সেও নিজের লোক, আর যদি কোন সমালোচনা করার থাকে সেও নিজেরই লোক। বিষয়টি একদমই আমরা আর মামুরা স্টাইলে চলেছে। এ এক কথিত জনমত ভ্যালিডেশনের স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মতন। তাই যে কোনো হুকুমতি ন্যারেটিভ বাজারে আসার সাথে সাথেই সেটিকে অকাট্য আর ওহী লেভেলের প্রমাণ করার রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকে উন্মত্ত হয়ে লেগে পড়তে দেখেছি।

আমরা বুঝতাম, যদিও নাগরিক হিসেবে কিছু বলতাম না। আর বাগধারার ছাপোষা মানুষেরা নাগরিক জীবনে মুখে কুলুপ এটে ধুম গরমে কের-কের শব্দ করা ফ্যানের নিচে সকালের আশায় ঘুমাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। এই যাপিত, বঞ্চিত, বাকহীন মানুষদের না ধরা হয় জীবনের দাম, না আছে মতামতের তোয়াক্কা। হ্যাঁ তবে সাধারণের লাশের দাম রাজনীতির বাজারে বেশ চড়া। তবে দাম তুলে নেয় কোনো না কোনো মহাজনই। 


বিজ্ঞাপন


তবে এই সাধারণ লোকেরা কিন্তু একটা সময় পর বুঝতে শিখে ফেলে, কিন্তু মহাজনেরা সেই বুঝতে শেখার আওয়াজ পায় না। ঠিক যেমনটা পায় না বাকশক্তি কেড়ে নেয়া মানুষের নিজেদের মাঝে যোগাযোগের পদ্ধতিগুলোর শব্দ। কারণ মহাজনের স্তুতিকাব্যের চেঁচামেচি এতোটাই সরব যে বাকি পৃথিবীর ভূমিকম্পও থোড়াই কেয়ার করে তারা। পরিণতি অথবা উদাহরণ- মাত্র কয়েকমাস আগেই অসম্ভব দাম্ভিক হাসিনা রেজিমের চূড়ান্ত পতন। 

কেন আর কিভাবেই বা তারা সীমানার শেষ খাঁজে পৌঁছেও বুঝতে পারে না। যে কোন দায়িত্বকে ক্ষমতা বলে প্রচার করতে করতে একসময় ক্ষমতার ভূত সওয়ার হয়ে পড়ে ব্যাক্তি আর গুষ্টির ঘাড়ে। তারপর আর তারা পেছনে তাকায় না, সেই ক্ষমতার ভূত তাদের চালায় অথবা তারা নিজেরাই ভূতের উপর ভর করে ক্ষমতা চালায়। এ ক্ষেত্রে মানুষ, জনগণ, পাবলিক যা ইচ্ছে বলি না কেন সবই ইউজলেস ক্যাপিটাল। জনবিচ্ছিন্নতাকে ক্ষমতার আড়ালে ফেলে ফালতু টাইপ অনুষ্ঠান আর আয়োজনে ব্যস্ত রাখা হয় সবাইকে। জমকালো, ফলাফলহীন দিবস/ অনুষ্ঠান নানান বিষয়ের ভিড়ে মানুষের নিত্যদিনের কষ্ট- দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে, বিদ্যুত-গ্যাস-পানির ব্যয় বেড়ে যায়। কাঁচাবাজারে সবজির দাম আকাশে উঠে- আর অন্যদিকে শহরের প্রায় প্রত্যেক হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিলনায়তন ভর্তি রাখা হয় মানুষ দিয়ে। দেশ ভর্তি মানুষের একমাত্র উল্লেখ করার স্থান হয় নেতার পোস্টারের নিচের ডানদিকে - প্রচারে জনগণ! 

যত কিছুই হয়ে যাক, একটা অদ্ভুত হতাশ নাগরিক জীবনে জনগণ এসব কিছুই কেয়ার করে না। অথবা মতের মূল্যায়ন না হতে হতে একসময় চুপ থাকার অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। আমাদের প্রায় সবাই সেই সাইলেন্স সিন্ড্রোমে ভুগছি। চব্বিশের আন্দোলন মানুষগুলোর নীরবতার সংযোগ তৈরি করে ফেলে। বিশেষ করে তরুণদের ন্যায্য দাবির মুখে স্বৈরশাসকের অনমনীয় আর তাচ্ছিল্য মানুষকে চরম বিরক্ত করে তুলে। পুরনো সব অপ্রাপ্তি, অন্যায্য ঘটনাগুলো খুব দ্রুত নিউরনে নিউরনে এক ধরনের ঢেউ সৃষ্টি করে যার প্রেক্ষিতে, অচেনা, অজানা কিছু ছেলেমেয়ে রাজপথে নামতে ডাকার সাথে সাথে সন্তানকে বুলেটের মুখে পাঠাতেও কার্পণ্য করেনি অভিভাবকেরা। জনতার নীরবতার শক্তি কতটা প্রবল তা ৩৬ জুলাই বলে দিয়েছে। 

তারপর কি হলো? মানুষ আবার নিজের জগতে ফিরে যাবে। নতুন সময়ে যে গ্যাপগুলোর কারণে নাগরিক জীবনে স্বস্তি ছিল না সেগুলোতে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করবে। আর ‘প্রচারে- জনগণ’ না থেকে ‘অগ্রাধিকারে- জনগণ’ হবার আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে। কিন্তু সমস্যা হলো- যারাই রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মার্কেটে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করছে, তাদের প্রায় সবাই আবারো একটা চরম ও মৌলিক ভুল করছে, আর সেটি হল- জনগণের নার্ভ না বুঝতে পারা। 


বিজ্ঞাপন


মানুষের রুচি- চিন্তা- মতামত ক্রমশই পরিবর্তনশীল। অপশাসনের সময়টাতেও অনেকে ভাবত দেশ বোধ হয় ঠিকঠাকই চলছে, ঠিক এই সাধারণ লোকেরাই আন্দোলনের সময়টায় এতোটাই বিরোধী হয়ে উঠে যা কোন রাজনৈতিক দল বিগত ১৬ বছরে করে দেখাতে পারেনি। তো এই যে মানুষের চিন্তা বদলানোর ধরন, সেই নার্ভ বুঝতে হলে কি করতে হবে? কয়েকটি বিষয় একেবারে প্রথমদিকে বিবেচনায় থাকতে হবে। বুঝতে হবে- মানুষ শো-ডাউন দেখে আর কোনভাবে আগ্রহী হচ্ছে না, বরং বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে কারণ এর চেয়ে বড় বড় শো-ডাউন তারা বিগত দেড় দশকে দেখেছে। রাজনৈতিক ননসেন্স আয়োজনের কারণে পথঘাটে যে জ্যাম সৃষ্টি হয় এটা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। এলাকায় এলাকায় চাঁদাবাজি করা লোকেদের দলকে মানুষ ঘৃণা করে।

ধর্ম-জাত নিয়ে উস্কানিমূলক কথাবার্তা নতুন প্রজন্ম একেবারেই খাচ্ছে না। গঠনমূলক কথা না বলে কেবল সমালোচনার উপর ভিত্তি করে যে বিষয়গুলো আগে মানুষ সহ্য করে যেত তা এখন অনেকটাই সরব হয়ে থামিয়ে দিতে চায়।  

তো এই বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর বুঝতে হবে কেন? কারণ পাবলিক রিলেশন্স আর মার্কেটিংয়ের ব্যাপারটাই এমন। কাস্টমার/ ক্লায়েন্ট/ সেবাগ্রহীতা যা-ই বলা হোক না কেন, তাদের পছন্দ-অপছন্দ না বুঝলে আপনার বিজনেস হবে না। তাই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের নার্ভ, রুচি না বুঝতে পারলে এর খেসারত তাদেরকেই দিতে হবে। আর হ্যাঁ, যদি যুক্তি আসে- পাবলিক চুপ করে আছে মানে তারা সব মেনে নিয়েছে! জনতার নীরবতা কতটা ভয়ানক আমাদের সবারই সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমন নজির হয়ে গেছে যে জুলাই মাসে ৩৬ দিন দেখেছে দেশের রাজনীতিবিদেরা। তাই এক লাইনে সারাংশ মানতেই হবে- নতুন বন্দোবস্তে জনতার নীরবতাকে সম্মতি ভাবাটাই হবে ভুল। মানুষের কাছে যান, আপনারা যেভাবে ভাবছেন সেভাবে না, জনগণ সত্যিই যেভাবে ভাবছে সেটাই নিজেদের আচরণে আর কর্মে আনার চেষ্টা করুন। আর দ্বিতীয় কোনো ভালো তরিকা নেই। 

লেখক: নীতি বিশ্লেষক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর