সিরিয়ার নতুন শাসনের নেতাদের অভ্যর্থনার পর, দেশটির সামনে এখনো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আসাদ শাসনের পতন ও তার পালানোর পর থেকে সিরিয়া নানা দুঃখ-কষ্ট ও সংঘাতের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। বাস্তুচ্যুতি, নির্যাতন ও কারাবরণের মধ্য দিয়ে যারা বেঁচে আছেন, তাদের কাহিনিগুলো মানবতার জন্য হৃদয়বিদারক। তবে সিরিয়ার পরিস্থিতির প্রকৃত পরিবর্তন এককভাবে এই নতুন শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে আসবে না। দেশটির সমস্যাগুলোর একটি অবিলম্বে সমাধান প্রয়োজন, যা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
নতুন শাসকদের পূর্ববর্তী আদর্শিক পটভূমি এবং রাজনৈতিক চিত্রপটের কারণে তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ও আরব বিশ্বে এক বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই নেতারা, যারা রাজনৈতিক ইসলামের কিছু মডেল অনুসরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের সম্পর্ক আল-কায়েদা, হায়াত তাহরির আল-শাম এবং অন্যান্য চরমপন্থী আন্দোলনের সাথে রয়েছে। এরা একদিকে যেমন সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা এবং রাষ্ট্রের ইসলামিকরণের মতো ধারণা প্রচার করেন, অন্যদিকে মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে দুর্ব্যবহারও করতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে এই নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং স্টেরিওটাইপের কারণে তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতে পারেন।
বিজ্ঞাপন
আসাদ শাসনের পতন সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। এসব দেশ ও শক্তি পরবর্তী পর্যায়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের পরিকল্পনা এবং চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করার জন্য সিরিয়াকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্পর্কের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে, যাতে বিভ্রান্তি ও সংঘাতের উৎসগুলো দূর করা যায়।
সিরিয়ার পরবর্তী রাজনৈতিক গতিপথের ওপর আমেরিকার প্রশাসনিক পরিবর্তনেরও প্রভাব পড়তে পারে। বাইডেন প্রশাসন থেকে ট্রাম্প প্রশাসনে ক্ষমতার হস্তান্তর সিরিয়ার ওপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনতে পারে। যদি ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের প্রতি বিরোধিতা করে, তবে এটি দেশটির জন্য এক নতুন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
সিরিয়ার সামনে এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য শুধু শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, বরং একটি সুষম ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন, যা দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সুসংহত করতে সক্ষম হবে।
সিরিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শাসন পরিবর্তনের পর, দেশটির সামনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সশস্ত্র দলগুলোর একত্রিতকরণ, অর্থনৈতিক সংকট, অন্তর্বর্তীকালীন বিচার ব্যবস্থা, এবং ইসরায়েলি দখলদারিত্ব সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের জন্য একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর কৌশল প্রয়োজন।
বিজ্ঞাপন
সিরিয়ায় সশস্ত্র দলগুলোকে একত্রিত করার প্রক্রিয়া সহজ নয়। বর্তমানে এটি মনে হতে পারে যে, এই কাজটি সহজ হবে, তবে বাস্তবে এটি আরও জটিল হয়ে ওঠে। বিশেষত যখন রাষ্ট্রের শক্তি, ক্ষমতা এবং ভূগোলের নিয়ন্ত্রণ স্পষ্ট হয়ে যায়, তখন জাতীয় সেনাবাহিনী তৈরি এবং সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়ে। সিরিয়া একটি বিভক্ত ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত, যেখানে প্রতিটি শক্তির অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর, নতুন সিরিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে তোলাও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এটি একটি জাতীয় ঐক্যের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে।
সিরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল এবং এটি নতুন সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। পূর্ববর্তী সরকার সম্ভবত সিরিয়ার কোষাগারে কিছুই রেখে যায়নি এবং এটি ঋণের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। এর ফলে নতুন প্রশাসনের জন্য ক্ষুধার চাহিদা মেটানো এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠন অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সহায়তা গ্রহণের প্রয়োজন পড়বে, তবে একে মূল্য ছাড়া পাওয়া যাবে না।
সিরিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ রয়েছে এবং এটি একটি কঠিন ও সংবেদনশীল বিষয়। বহু মানুষ ক্ষতিপূরণের দাবি করছে এবং কেউ কেউ প্রতিশোধ নিতে চায়। এই সমস্যাগুলোকে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপের মাধ্যমে মোকাবেলা করা জরুরি, যাতে জনগণ তাদের হারানো অধিকার ফিরে পায় এবং ক্ষতির জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায়। এটি সিরিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিরিয়ার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব। গোলান উচ্চভূমি এবং মাউন্ট হারমনসহ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের দখল সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়ার নতুন সরকার যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চায়, তবে এটি আন্তর্জাতিক চাপ ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। সিরিয়ার জনগণ ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে নিরাপত্তার অনুভূতি আশা করছে, এবং এটি একটি শক্তিশালী এবং সমর্থনকারী অবস্থান তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে।
সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে তারা যদি জনগণকে একত্রিত করে এবং তাদের অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ তৈরি করতে পারে, তাহলে সাফল্য সম্ভব। অতীতের ভুলগুলো থেকে শিখে, শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চললেই সিরিয়া একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যত নির্মাণ করতে পারবে।
লেখক: কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক

