সন্দেহ নেই, শাম তথা সিরিয়ার কসাইখ্যাত বাশার আল আসাদের পতনে মুসলিম বিশ্ব আজ খুশি। স্বৈরাচারদের জন্য সাধারণত এভাবে পালিয়ে যাওয়া অথবা জনরোষে নিহত হয়ে অপমানকর মৃত্যুই হয় শেষ পরিণতি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাশারের পতনের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার মুক্তিকামী মজলুম মানুষের মুক্তি হলো কি না, আর হলেও তা কতটুকু স্থায়ী হতে পারে তার জন্য সম্ভবত আরও অপেক্ষা করতে হবে।
জুলুমের অবসান, মজলুমের মুক্তি এবং জালিমের পতন আমরা সবাই চাই। আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়াতে তাই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতেও এমনটি মনে হবে কি না তা নিয়ে বাস্তবসম্মত যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অনেকেই মনে করছেন, বাশারের পতন কেবল আরেকটি স্বৈরাচারের পতনই নয়, বরং একইসঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়া ও আঞ্চলিক শক্তি ইরানেরও পতন। দীর্ঘদিনের সিরিয়ার এ প্রক্সি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিশ্বের তাবৎ পরাশক্তিগুলো। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্ররা। অন্যদিকে রাশিয়া, ইরান ও বাশারপক্ষ। আরেক দিকে তুরস্ক ও বাশার-বিরোধীপক্ষ। এর বাইরেও আরও পক্ষ রয়েছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া, ইরান ও বাশারপক্ষের পতন আমরা দেখতে পাচ্ছি। সে হিসেবে তুরস্ক ও বাশার-বিরোধী বিজয়ী পক্ষই সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা। বাস্তবে তারা খুশিও। একে একে বন্দিরা ভয়ংকর সব কারাগার থেকে মুক্ত হচ্ছেন। অনেকেই নিজ বাড়ি কিংবা বসতভিটায় ফিরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তুরস্কে আশ্রয় নেয়া ৩০ লাখেরও বেশি সিরিয়ানদের একটা অংশ হয়তো সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তন করতে পারেন। কিন্তু সিরিয়াকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদীদের ওই অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের কি পরিসমাপ্তি হলো? আমার কাছে এখনো তা মনে হচ্ছে না। এমনটি মনে না হওয়ার অন্য একটি কারণ হলো, বাশারের পতনে তুরস্ক ও বাশারবিরোধী পক্ষের চেয়েও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও পশ্চিমা ব্লককে বেশি খুশি হতে দেখা।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দামেস্ক দখলকারী গ্রুপটিকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। এটা কি মুসলিম এই গ্রুপটির দাবির মুখে তারা করছে? নাকি কোন পূর্বশর্তের অংশ হিসেবে? কোন পূর্বশর্তের অংশ হিসেবে হলে অজানা বাকি শর্তগুলো কি কি? যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যেখানে বিশ্বের যেকোনো দেশে মুসলিম কোনো দলের উত্থানকে ভালো চোখে দেখে না, সেখানে সিরিয়াতে হওয়া এই উত্থানকে তারা এতো সেলিব্রেট করছে কেন? যা সাধারণত তাদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের সঙ্গে যায় না। মিশর ও তিউনিসিয়ায় তারা কী করেছে তা গোটা বিশ্ব দেখেছে। তাছাড়া আফগানিস্তানে দীর্ঘ দুই দশক তাদের লড়তে দেখেছে বিশ্ব।
এদিকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যাভিড ল্যামি সংসদে এক বক্তব্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন, বাশার আল আসাদকে অনেকেই 'দামেস্কের সিংহ' বলত। এখন দেখি, সে 'দামেস্কের ইঁদুরে'র মতো লেজ গুটিয়ে মস্কোতে পালিয়েছে। বুঝতে পারছেন তাদের খুশির মাত্রা?
বিজ্ঞাপন
এদিকে বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী ইসরায়েল গত কয়েকদিনে সিরিয়ায় প্রায় ৫০০ বারের মতো হামলা করেছে। তাদের টার্গেট সিরিয়ার মিলিটারি স্থাপনা ও সরকারি পাবলিক সার্ভিসে নিয়োজিত অবকাঠামোগুলো। সব ধবংস করে দিচ্ছে। গোলান মালভূমির আরও কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা দামেস্ক দখলকারী বিজয়ী গ্রুপ কেউ এদের থামতে বলছে না।
এদিকে তাদের বাঁধা দেওয়ারও যেন এখন আর কেউ নেই। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়া যাতে কোনোভাবে দাঁড়াতে না পারে, সম্পূর্ণ বিনা বাঁধায় অবকাঠামো ধবংস করে তা যেন নিশ্চিত করছে ইসরায়েল।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পশ্চিমা দেশগুলোর এই সেলিব্রেশন সিরিয়া থেকে শুধু রাশিয়া ও ইরানের বিদায়ের জন্য, নাকি এর পেছনে রয়েছে আরও বড় কোনো পরিকল্পনা? সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ সুগম হওয়ার কোনো আগাম ইঙ্গিত কি রয়েছে এই উচ্ছ্বসিত সেলিব্রেশনে? অন্যদিকে রাশিয়া কিংবা ইরান কি এ পরাজয় মেনে নিয়ে চুপ থাকবে?
তুরস্কের জন্য পশ্চিমের পালিত বিষফোঁড়া হচ্ছে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে গড়ে ওঠা শক্তিশালী কুর্দিশ গ্রুপ। যারা তুরস্কের ভেতরের কুর্দিশ গ্রুপের সঙ্গে মিলে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের অংশগ্রহণ ও কিছু এলাকা দখলে নেওয়া মূলত এই গ্রুপটিকে নিয়ন্ত্রণ রাখা অথবা দুর্বল করার জন্য। অথচ এই গ্রুপটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি নিয়মিত সহায়তা করে যাচ্ছে এবং এদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিলেই তারা মানবাধিকার লংঘনের অজুহাত তুলে তুরস্ককে ধুয়ে দেয়।
এখন দেখার বিষয় হলো, বাশারের পতনে পশ্চিমাদের সহায়তায় এরা কি আরও শক্তিশালী হয়ে তুরস্কের ওপর মরণকামড় দেবে নাকি তুরস্ক আজকের এই বিজয়ী পক্ষের সহায়তায় এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনই জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আজকের এই বিজয়ী পক্ষ যদি সত্যিকার অর্থে পশ্চিমাদের সঙ্গে কোনো শর্তের ভিত্তিতে রাশিয়া ও ইরানকে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করতে বাশারের পতন ঘটিয়ে থাকে, তাহলে তুরস্ক সীমান্তের কুর্দিশ গোষ্ঠীকে দমনে তারা তুরস্ককে সহায়তা করবে কেন? তারা তো শর্ত অনুযায়ী পশ্চিমাদের কথার বাইরে যেতে পারবে না। বিশেষ করে এই ধবংসস্তুপ থেকে ধীরে ধীরে সিরিয়াকে আবার গড়ে তোলার জন্য হলেও তাদের পশ্চিমাদের সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হতে পারে। এই জটিল সমীকরণের ওপরই নির্ভর করছে ২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রেট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যের আরেক বড় স্বৈরাচার বাশার আল আসাদ পরবর্তী সিরিয়ার ভবিষ্যৎ।
আবু সালেহ ইয়াহইয়া
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক, (তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য)

