বাংলাদেশ নামের আমাদের প্রিয় জন্মভূমি এখন সত্যিই এক ক্রান্তিকালে পৌঁছেছে। প্রতিটি ক্রান্তিকালেই ভ্রান্তিজালে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা যাতে সেই বেড়াজালে ধরা না দেই তার জন্য এখন দরকার সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সচেতনতা।
আমাদের এই দেশজাতির বিরুদ্ধে এখন চলছে সীমান্ত পারের চক্রান্ত। বিশ্বজুড়ে কুৎসা রটাচ্ছে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক কুইসলিংরা সবখানে পেতেছে ভয়ঙ্কর বিভেদ ও ষড়যন্ত্রের ফাঁদ। ওরা এই রাষ্ট্রকে হত্যা করতে চায়। এ জাতিকে পিষে মেরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায়। বাংলাদেশিদের বিভক্ত করে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত করিয়ে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করতে চায়।
বিজ্ঞাপন
দেড় যুগে জগদ্দল পাথর হয়ে বসা গণঘাতক ও লুটেরা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এ জাতি এই তো সেদিন সিসেঢালা ঐক্যের প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। ছাত্র-তরুণেরা, মুসলমান-হিন্দুরা, প্রাচুর্যবান-দরিদ্ররা সবাই এক কাতার হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সকলের রক্তধারা মিলিত হয়ে রচনা করেছে দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের বিজয়গাথা। কিন্তু সেই বিজয়কে সংহত করার আগেই আজ আমরা শিথিল করে ফেলেছি ঐক্যের বাঁধন। আমরা বিভক্ত ও আলাদা হয়ে গেছি। এই শৈথিল্যের কারণেই শত্রুরা তাদের চক্রান্তকে শাণিত করতে পেরেছে।
আগেই বলেছি, ক্রান্তিকালের কথা। ক্রান্তিকাল কেবল বিপদ আর শঙ্কারই নয়, ক্রান্তিকাল কিন্তু সম্ভাবনারও। আমাদের এই জাতি এবং এই রাষ্ট্র খুব নিখুঁতভাবে পরিগঠিত হতে পারেনি - এ অভিযোগ গোড়া থেকে অনেকেরই। এবার কিন্তু জাতিকে ও রাষ্ট্রকে গড়ে তুলবার এক সুবর্ণ সুযোগ এই ক্রান্তিকাল আমাদের সামনে এনে হাজির করেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
জাতি ও রাষ্ট্রগঠনের সুযোগের বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে আমি আজ এ লেখায় কেবল এদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাতে চাই। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই সংখ্যালঘু পরিচয়টিই মনোজাগতিক এক দুর্বলতার স্মারক। এই পরিচয় নিজেকে ছোট ও শঙ্কিত করে রাখে। এ পরিচয় সংকোচ ও হীনম্মন্যতার দিকে ঠেলে দেয়। মানসিক এ দুর্বলতা দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে শক্তিশালী কোনো ত্রাণকর্তার করুণার ভিখারী করে তোলে। আর তারা তাদের নানান স্বার্থের ক্রীড়নক হিসেবে এই দুর্বল মানুষদের ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভাগ্যেও তাই ঘটে চলেছে। হিন্দুপ্রধান বৃহত্তর প্রতিবেশীটি বাংলাদেশি হিন্দুদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের কাছ থেকে বাড়তি ফায়দা হাসিল করেছে কিংবা ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছে। অপরদিকে দেশের একটি রাজনৈতিক দল তাদেরকে কেবল ভোটব্যাংক হিসেবেই ব্যবহার করেনি, রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে শক্তিপ্রদর্শনের হাতিয়ারও করেছে। কিন্তু এই সব ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের হিন্দুদেরকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও মর্যাদা অর্জনের বদলে তথাকথিত ত্রাণকর্তাদের হাতে জিম্মি হিসেবেই থাকতে হয়েছে। কাজেই সংখ্যালঘু হিসেবে এই পুতুলের ভূমিকা আজ মুছে ফেলার দিন।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ আজ যখন বাইরে থেকে আক্রান্ত এবং আগ্রাসী শক্তির ক্রীড়নকেরা যখন জাতিদ্রোহী অপতৎপরতায় লিপ্ত তখন হিন্দু নাগরিকেরা জাতীয় ঐক্যের মূলস্রোতধারায় শামিল হয়ে জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেন। মাঠে-ময়দানে, অনলাইন-অফলাইনে এবং সম্ভাব্য প্রতিটি মাধ্যম ও পন্থায় ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে তারা তাদের এ অবস্থান ঘোষণা করতে পারেন। তাদের এই ভূমিকা আজ জাতীয় স্বার্থে অনেক বেশি প্রয়োজন। এই ভূমিকা সঠিক ভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করতে পারলে ইতিহাস বদলে যাবে। আমি মনে করি, সিকিমের হিন্দুদের মতো নতজানুতা নয়, নেপালের হিন্দুদের মতো বাংলাদেশের হিন্দুদের আত্মমর্যাদা নিয়ে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়াতে হবে এবং এখনই সময়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব।
ই-মেইল : [email protected]