গত ১১ নভেম্বর থেকে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৯)। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস এবং পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসান অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন।
সম্মেলনে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন আপডেট, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এইবারের কপে একটা বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল অন্যান্য আলোচনা ও বিষয়ের পাশাপাশি ড. মুহাম্মদ ইউনুস তার স্বপ্নের ‘থ্রি জিরো’ মডেলের কথা বলেছেন। এই মডেল কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সহায়ক হতে পারে সেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং বিশ্ববাসীর সহযোগিতা চেয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ২৯-এর ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার সময় ড. ইউনূস বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য, আমাদের আরেকটি সংস্কৃতি গঠন করতে হবে। এটি হবে শূন্য বর্জ্যের ওপর ভিত্তি করে। এ সংস্কৃতি নিত্য পণ্যের ব্যবহারকে সীমিত করবে এবং কোনও বর্জ্য অবশিষ্ট রাখবে না।’
পৃথিবীকে জলবায়ু বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন নির্ভর জীবনধারা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, তার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন, পৃথিবী তিন শূন্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এই জীবনযাত্রাও হবে শূন্য কার্বনের ওপর ভিত্তি করে যেখানে কোন জীবাশ্ম জ্বালানি থাকবে না, শুধুমাত্র পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি থাকবে। এতে এমন একটি অর্থনীতি গড়ে উঠবে যেখানে প্রাথমিকভাবে সামাজিক ব্যবসার মতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে শূন্য মুনাফা ভিত্তিক ব্যবসা গড়ে উঠবে।’
সামাজিক ব্যবসাকে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য একটি নন-ডিভিডেন্ড ব্যবসা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে তিনি বলেন, ‘সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবন কেবল সুরক্ষিতই হবে না, গুণগতভাবে উন্নত হবে। এটি যুবকদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজতর করবে। উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন শিক্ষার মাধ্যমে তরুণরা প্রস্তুত হবে। চাকরিপ্রার্থী তৈরির শিক্ষা উদ্যোক্তা-কেন্দ্রিক শিক্ষা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।’
বিজ্ঞাপন
পরিবেশের সুরক্ষার জন্য একটি নতুন জীবনধারার প্রয়োজন উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘তরুণরা এ জীবনধারাকে পছন্দ হিসেবে বেছে নেবে। প্রতিটি যুবক তিন শূন্য ভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে। এগুলো হচ্ছে- শূন্য নেট কার্বন নির্গমন, শুধুমাত্র সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে পরিণত করার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষ তিন শূন্য ভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে এবং সারাজীবন তিন শূন্য ভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে থাকবে। এটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলবে।’ এ গ্রহের নিরাপত্তার স্বার্থেই সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তুলতে হবে। আর আজকের তরুণ প্রজন্ম বাকিটা করবে। কারণ তারা তাদের গ্রহকে ভালোবাসে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমি আশা করি আপনারা এই স্বপ্ন দেখায় আমার সাথে যোগ দেবেন। আমরা যদি একসাথে স্বপ্ন দেখি তবে তা সম্ভব হবে।’
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে এবং সে কারণে মানব সভ্যতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তারপরও মানুষ আত্ম-বিধ্বংসী মূল্যবোধের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
‘এই গ্রহের মানব বাসিন্দারাই এ গ্রহের ধ্বংসের কারণ’ উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এ গ্রহের ক্ষতি করছে এবং তারা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছে যা পরিবেশের বিরুদ্ধে কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, ‘এই অর্থনৈতিক কাঠামোটি সীমাহীন খরচের ওপর ভিত্তি করে চলছে। আপনি যত বেশি ব্যবহার করবেন তত বেশি প্রবৃদ্ধি পাবেন। যত বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেন, তত বেশি অর্থ উপার্জন করবেন। সর্বাধিক মুনাফা অর্জনকে সিস্টেমের সবকিছুকে আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভূমিকা পালনে চালিত করার শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।’
প্রফেসর ড. ইউনুসের আলোচনা বিশ্ববাসীর কাছে খুব গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে এবং ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাধারণ সমাধানের বাইরে নতুন কিছু সমাধানের পন্থা পেয়েছে বিশ্ববাসী।
এছাড়াও এই বছরের কপ সম্মেলনে উঠে আসে, বিশ্বজুড়ে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ, যা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে ঘটে, এ বছর তা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর পথে রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলনে প্রকাশিত গ্লোবাল কার্বন বাজেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ৪১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছাবে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ বিলিয়ন টন বেশি।
এই নিঃসরণের প্রধান অংশ আসে কয়লা, তেল এবং গ্যাস পোড়ানো থেকে, যা ২০২৪ সালে ৩৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন টন ছাড়িয়ে যাবে, এবং যা ২০২৩ সালের তুলনায় ০ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
অবশিষ্ট নিঃসরণ আসে স্থলভাগ থেকে, যেমন বন ধ্বংস ও অগ্নিকাণ্ডের মতো কার্যক্রম থেকে। এ গবেষণায় ৮০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে, নেতৃত্ব দেন যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানী পিয়েরে ফ্রিডলিংস্টেইন।
পিয়েরে ফ্রিডলিংস্টেইন সতর্ক করে বলেন, যদি নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে।
কিন্তু বাস্তবে গত দশকে জীবাশ্ম জ্বালানির নিঃসরণ বাড়ছেই। যদিও ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত নিঃসরণ কিছুটা কমে এসেছিল, এ বছর আমাজনে খরার কারণে অগ্নিকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন, এই ধীর গতির কারণে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্য অর্জন এখন বাস্তবসম্মত নয়।
এ বছর কিছু দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহারে অগ্রগতি দেখালেও, উন্নতি ছিল খুবই অসম। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর নিঃসরণ কমলেও, উন্নয়নশীল দেশের নিঃসরণ বাড়ছে।
১২ নভেম্বর, কপ২৯ সম্মেলনে অংশ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল—পৃথিবীজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের নেতৃত্ব কে দেবে এ নিয়ে।
আয়োজক আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর অভিযোগ এনে বলেন, তারা অন্যদের জ্বালানি ব্যবহারে পরামর্শ দিলেও নিজেরাই বৃহৎ ভোক্তা ও উৎপাদক।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের নিঃসরণ ০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিঃসরণ ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কিন্তু ভারতের নিঃসরণ ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়বে, যা তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ চাহিদার জন্য। চীনের নিঃসরণও সামান্য ০ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে, তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে তেল থেকে নিঃসরণ শিগগিরই কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিমান ও জাহাজের পরিবহন থেকে নিঃসরণও ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়বে, কারণ কোভিড-১৯ মহামারির পর বিমান ভ্রমণের চাহিদা পুনরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এইবারের সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কানাডার প্রধানমন্ত্রী, চীনের রাষ্ট্র প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট না আসার বিষয়কে খুব ভালোভাবে দেখছেন না পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ। ধারণা করা হচ্ছে এই দেশসমূহ না আসা প্রমাণ করে তাদের জলবায়ু পরিবর্তনে দায় কি পরিমাণ। কিছু কিছু দেশ উন্নয়নশীল দেশসমূহের কাছে ক্ষতিপূরণও চেয়েছেন।
সর্বোপরি, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন থেকে সামষ্টিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু বেনেফিট লাভ করবে এবং কতটুকু ভুমিকা রাখতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ -সংশয় থাকলেও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের প্রকৃত সমস্যা ও সমাধান তুলে ধরার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান পরিস্কার করেছেন। যেহেতু এটি একটি বড় ইস্যু, তাই তাৎক্ষণিক কোনও সমাধান না হলেও আমরা বিশ্বাস করি ক্রমান্বয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাংলাদেশের তথা পুরো পৃথিবীর সকল দেশ উপকৃত হবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্নেন্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট - সিজিডি