বিশ্বকে চমকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটির ইতিহাসে এমন বিজয় খুব বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একবার পরাজিত হওয়ার পর একই ব্যক্তির দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। ট্রাম্প শুধু দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরেননি, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির কমলা হ্যারিস। দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিতর্ক ছিল উপভোগ্য, কখনো মনে হতো কমলা হ্যারিসের কাছে ট্রাম্প ধরাশায়ী হয়েছেন, আবার কখনো মনে হতো ডোনাল্ড ট্রাম্পই বিজয়ী হবেন। পারস্পরিক বিতর্কে তারা একে অন্যকে নাস্তানাবুদ করেছেন।
কমলা হ্যারিস বিশ্বশান্তি, স্বাস্থ্যসেবা বাড়িয়ে ও করের বোঝা কমিয়ে আমেরিকার জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার পাশাপাশি ভূরাজনীতিতে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ, অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন ও ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির পক্ষে জোর প্রচার চালিয়েছেন। মার্কিন জনগণ শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসে ফিরছেন ট্রাম্প। জয়ের আগে প্রচারের সময় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ছিল অর্থনীতি, অভিবাসন ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসংক্রান্ত বিষয়। আরও ছিল অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে দেওয়া, জলবায়ু নীতিতে কাটছাঁট, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ, গর্ভপাতের অধিকার রদ, ৬ জানুয়ারির দাঙ্গাকারীদের ক্ষমা, বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথকে চাকরিচ্যুত।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জয়ের পরদিনই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমি একটি সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করব। সেটি হলো—যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সেগুলো প্রতিপালন করা। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করব।’ নির্বাচনী প্রচারের সময় একটা কথা ট্রাম্প বারবার বলেছেন। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করবেন তিনি। এ ছাড়া মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
তবে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছুটা বাঁকা চোখে দেখছেন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা। বিবিসিকে তারা বলেন, যে পরিমাণ অভিবাসীকে ট্রাম্প ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন, তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বিশাল আইনগত ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এ ছাড়া এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির গতিও কমিয়ে দিতে পারে। ফিলিস্তিনের গাজা যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিজেকে ইসরায়েলের একজন কড়া সমর্থক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।
নির্বাচনের পরপরই বুথফেরত জরিপে দেখা গিয়েছিল, ভোটারদের কাছে অন্যতম বড় একটি বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতি থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে নিত্যপণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতায় উঠেছিল। এ ছাড়া কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বিদেশি পণ্যের ওপর নতুন অন্তত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে চান। আর চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়াতে চান অতিরিক্ত ৬০ শতাংশ।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। ট্রাম্পের জয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের জন্য বাংলাদেশের সরকার ও শান্তিপ্রিয় জনগণ শান্তি, সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির সাধনায় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপনার অংশীদারত্ব ও সহযোগিতার অপেক্ষায়। আপনার মহান জাতির নেতৃত্বের এই গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা শুরু করার সময় আপনার সাফল্যের জন্য আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বরাবর শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদেরও উদ্দেশ্য রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্পন্ন করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বৃহত্তম তৈরি পোশাক আমদানিকারক দেশ, বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী দেশের তালিকারও শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীর সংখ্যাও ব্যাপক; তারা রেমিটেন্স এ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারত্ব রয়েছে। চীনকে প্রতিহত করার কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব অনেক। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এ কৌশলের কোনো পরিবর্তন নাও আসতে পারে।
ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা শোনা যায়। তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত আবেগ তেমন স্থান পাবে বলে মনে হয় না। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাস্তবতা বা রিয়েল পলিটিকস। বাস্তবতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থে যা যা করার দরকার, সেগুলো সামনে রেখেই এগোবে। এখানে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ নয়।
নির্বাচনী প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় কথিত অনুপ্রবেশ বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাতে অন্যান্য উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের মতো বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে আশার কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে চাইলেই প্রেসিডেন্ট যা কিছু করতে পারেন না। তাকে কংগ্রেস ও আদালতের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলে কয়েকটি মুসলিম দেশ থেকে অভিবাসী নেওয়া বন্ধের ঘোষণা দিয়েও তিনি তা কার্যকর করতে পারেননি।
যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণীত হয় সেই রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের নিরিখে। সেখানে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিংবা ক্ষমতার পালাবদলে তেমন ভূমিকা রাখে না। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চাইবে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থেই। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে চলেছে। এসব অপপ্রচার ও গুজবের বিরুদ্ধে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।
নির্বাচনী প্রচারের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এক্স বার্তায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্দয়ভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবে এসব বার্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর বদলে যেতে পারে। তবে আমাদের এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলে কোনো বিভাজন থাকবে না। সকল মানুষ সমতা ও ন্যায্য অধিকার ভোগ করবে। এতে কেউ অপপ্রচার চালিয়ে বা গুজব ছড়িয়ে সুবিধা করতে পারবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলেও বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গভীর ছিল, যার কথা প্রধান উপদেষ্টাও উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে সেই সম্পর্ক আরও জোরদার হবে আশা করা যায়।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্থিতিশীল সম্পর্ক রয়েছে, সেটা স্থিতিশীল থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ প্রভাব বলয়ের ক্ষেত্রে একটা সম্প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এটি ভারতের জন্য অসুবিধার কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটা সুসম্পর্ক আছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সেটা অব্যাহত থাকবে। এখানে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নাও আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় বাংলাদেশ খুব বড় আকারে আসে না।
ভারতের অনেক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে অনেক কিছু অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে। ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। ট্রাম্পের জয়ে দেশীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগও বেজায় খুশি। তারা ভাবছে, ট্রাম্প আসায় শেখ হাসিনার চট করে চলে আসার অভিপ্রায় পূরণ হতেও পারে। সেই পুলকে বিজয়ী ট্রাম্পকে শেখ হাসিনা অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ যতই লবিং করোকনাকেন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান এত সহজে হবে না। তবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যে যেভাবেই বলুক যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বিশেষ করে ট্রাম্পের আবার মসনদ আরোহণ বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে অতীতে মার্কিন রাজনীতিকদের, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বেশ আলোচিত বিষয়। তাই ট্রাম্পের জয়ে বাংলাদেশের জন্য কী হবে- প্রশ্নটি অমূলক নয়। তবে এটা নির্ভর করবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর।
সাধারণত আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট বদল হলেও বৈদেশিক নীতিতে খুব বড় পরিবর্তন হয় না। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা বা কাঠামোগুলোর একটি শক্তিশালী ভূমিকা থাকে। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কী হবে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রে বরাবরের মতো এটাই চায় যে বাংলাদেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসুক। অর্থনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে বলা যায় বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্য সম্পর্ক অনেক পুরানো। পোশাক রফতানিকারকদের মতে, বৈশ্বিক পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি দেশের পোশাক শিল্পের জন্য আগামী বছরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রফতানির বৃহত্তম একক রফতানি গন্তব্য হওয়ায় এই নীতি পরিবর্তন চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক উৎপাদনকারী বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে রিপাবলিকান ট্রাম্পের। তার এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বাড়তে পারে। তবে মোটাদাগে বলতে গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর কোনো চাপ আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ সরকার দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এগুতে হবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক।