শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

আরিফুজ্জামান মামুন
প্রকাশিত: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২১ এএম

শেয়ার করুন:

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

মাস দিন পেরিয়ে এখন ঘণ্টার অপেক্ষা। আর কিছু সময় পরই মার্কিন ভোটাররা বাছাই করবেন তাদের প্রেসিডেন্ট। বিশ্বের ক্ষমতাধর সেই প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে। নির্বাচনের ফলাফলের পরই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কোনদিকে এগোবে বিশ্বনেতাদের। তাই বৈদেশকি নীতি থেকে শুরু করে অভিবাসী কিংবা আভ্যন্তরীণ ইস্যুতে প্রার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই পুরো পৃথিবীরও চোখ থাকে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয় বরং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি কীভাবে বদলাবে এবং সেটি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি পুনরায় নির্বাচিত হন, তাহলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গতিপথ কী হতে পারে, তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত আলোচনা করছেন।


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি ট্রাম্প একটি টুইটে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে এবং তিনি এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এই টুইটের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন পুনরায় ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কঠোর হতে পারে। আবার অন্যদিক থেকে অনেকেই বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত নির্দিষ্ট কাঠামো ও নীতিগত দিকনির্দেশনার অধীনে পরিচালিত হয়। ফলে, প্রেসিডেন্ট যেই হোন না কেন, নীতিগত পরিবর্তন খুব বেশি হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর স্থায়িত্ব। প্রতিটি প্রশাসনের অধীনে কিছু নির্দিষ্ট কৌশলগত নীতি পরিবর্তিত হলেও, দেশটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রগুলোয় বড় ধরনের পরিবর্তন সাধারণত দেখা যায় না। এর পেছনের কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রভাব। কংগ্রেস, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, এবং অন্যান্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। ফলে যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেন, তিনি কোনো কৌশলগত দিক পরিবর্তন করলেও মূল কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে।

তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যে ধরনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি দেখা গেছে, সেটি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য কিছুটা জটিলতা তৈরি করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যে একাধিক দেশের ওপর নতুন বাণিজ্য নীতি আরোপ করেছে, সেটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক টুইট বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তার পুনরায় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি মানবাধিকার ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।

সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনুস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করতে পারে। ইউনুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু হতে পারে। যেহেতু ড. ইউনুস যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন, তাই তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ দেখা যেতে পারে।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বর্তমানে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক সুদৃঢ়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্য অংশীদার। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি মার্কিন বাজারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রযুক্তি ও উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়াও নিরাপত্তা সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কার্যক্রম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে ট্রাম্প প্রশাসন আবারও ক্ষমতায় এলে কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং চীনের সঙ্গে তার কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের জন্য কিছু ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ বাড়তে পারে। চীন থেকে বাংলাদেশে আসা বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের নজরে থাকবে।

বিশ্ব রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মার্কিন নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একটি নির্দিষ্ট রূপ পেতে পারে। যদি ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিত হন, তাহলে মানবাধিকার ইস্যুতে তিনি বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। তবে, বাইডেন প্রশাসনের নীতির ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলতে থাকবে বলে অনেকে মনে করেন। বাংলাদেশের জন্য এক্ষেত্রে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সুযোগও তৈরি হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে আগ্রহী হলে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। একইসঙ্গে বাণিজ্য ও কৌশলগত সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশকে নতুন কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি প্রবাসীরা দেশটির অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন এবং বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রেরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। প্রবাসীদের ওপর মার্কিন অভিবাসন নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকলেও তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সাধারণত সচেতন থাকে। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে অভিবাসন নীতি কঠোর হলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর তেমন প্রভাব পড়েনি। তবে ভবিষ্যতে অভিবাসন নীতির পরিবর্তন ঘটলে, তা প্রবাসীদের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য মার্কিন নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, এবং তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন না ঘটলেও, ভবিষ্যতে সম্পর্ক আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। নতুন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ও মানবাধিকার বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এ সুযোগ ব্যবহার করে বৈশ্বিক মঞ্চে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পথ তৈরি হতে পারে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ভর করবে নতুন প্রশাসনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের ওপর। ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচিত হলে বাংলাদেশ মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষায় নতুন চাপের মুখে পড়তে পারে। অন্যদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য নতুন কৌশলগত সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী অবস্থান এবং বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও মজবুত হতে পারে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর