সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। তাই সামরিক ও অসামরিক উভয় অঙ্গনে নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক, রণকৌশল ইত্যাদি বিষয়ক কোর্স কারিকুলামের একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া (Decision Making Process) গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সার্বজনীন সাতটি ধাপ সম্পর্কে বেসামরিক অঙ্গনে আমরা অনেকেই জানি এবং সামরিক বাহিনীতে প্রচলিত Appreciation পদ্বতি বা DMP পদ্বতি সম্পর্কেও সামরিক অফিসারদের ভালো জানা আছে। সামরিক বাহিনীতে যুদ্ধকালীন উচ্চ পর্যায়ের কমান্ডারদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্যের জন্য অনেক স্টাফ অফিসাররা কাজ করেন। অনেক পরিকল্পনা ও ওয়ার গেম করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন টেমপ্লেট ও tools প্রস্তত রাখেন। কিন্তু কখনও কখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এইসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বা সুযোগ থাকে না, সিদ্ধান্ত যত জটিল ও যত গুরত্বপূর্ণই হোক। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার জন্য যথাযথ সময়-সুযোগ থাকুক বা না থাকুক, জটিল পরিস্থিতিতে ঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারেন, তারাই ইতিহাসে যথাযথ স্থান পান।
বিজ্ঞাপন
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ২৪ এর প্রেক্ষাপট, জটিল পরিস্থিতি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায়, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার মুখোমুখী না করে দেশের জনগণের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত ইতিহাসে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারকে কীভাবে স্থান দেবে, সেটা ইতিহাসই ঠিক করবে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭১ পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো সেনাপ্রধানদের এতো বড় ক্রান্তিকাল ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
বর্তমান সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করার সুবিধার্থে আমরা ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেখে নিতে পারি কোন কোন সেনাপ্রধান জাতির কী ধরনের ক্রান্তিকালে জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে, সকল সামরিক, আধা সামরিক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানদেরই তাদের অবস্থান ও কর্মযজ্ঞ বিবেচনায় অনেক কঠিন ও জটিল সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু এখানে আমি জাতির বিভিন্ন ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালের প্রেক্ষাপটে জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় কয়েকজন সেনাপ্রধানদের সিদ্ধান্ত তাদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোচনার চেষ্টা করছি।
মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যেকোনো বড় ধরনের দুর্যোগই জাতীয় সংকট। তবে আলোচনা সীমিত রাখার সুবিধার্থে আমরা দুর্যোগ মোকাবেলা সংক্রান্ত সংকট নিয়ে এখানে আলোচনা করব না।
বিজ্ঞাপন
৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকাল। ওই সময়ে জেনারেল ওসমানী এবং তার কমান্ডারগণ অনেক জটিল, সাহসী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনা শুধু ৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের মধ্যে সীমিত থাকবে। তাই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়কে আলোচনায় আনছি না।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ক্রান্তিকালের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেনাপ্রধান হিসেবে তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি কী করতে পারতেন বা পারতেন না, এগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও তিনি জাতীয়ভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি বা করতে পারেননি।
পরবর্তী সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের ফলে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে বিপ্লবের কথিত নেতৃত্বদানকারী দল জাসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বা জাসদকে সমর্থন দিয়ে জাসদকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার কথা ছিল বলে জাসদ যে দাবি করেন, সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়া তা না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রেখেছিলেন। কারণ বামপন্থী এই দলটি কর্তৃক তখনকার পরিস্থিতিতে দেশের শাসনভার গ্রহণ ও বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা হলে ধারণা করা হয় যে প্রতিহিংসার রাজনীতির পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা হতো। পরবর্তীতে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে কম্যুনিজমের ব্যর্থতা সুস্পষ্ঠভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যেই হোক, প্রধান সামরিক আইন শাসক ও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত দেশের জন্য গুরত্বপূর্ণ, প্রশংসিত বা সমালোচিত হলেও, আমাদের আজকের সেনাপ্রধানদের জটিলতর সিদ্ধান্ত গ্রহণের তুলনামূলক আলোচনয় এগুলো প্রাসঙ্গিক নয়।
জেনারেল এরশাদ সেনাপ্রধান থাকাকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়ার অত্যন্ত দুঃখজনক হত্যাকাণ্ড জাতির ইতিহাসে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। তখনকার সময়ে তিনি তৎক্ষণাৎ ক্ষমতা গ্রহণের সাহস না দেখালেও অথবা পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতা গ্রহণ না করলেও, পরবর্তীতে বিচারপতি সাত্তারের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাত করে সামরিক শাষণ জারি ও রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ইতিহাসে তাকে অনেক সমালোচিত সেনাপ্রধান হিসেবেই স্থান দিয়েছে। পরবর্তী সেনাপ্রধান জেনারেল আতিককে জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় তেমন কোনো জটিল সময়ের মুখোমুখি হতে হয়নি।
অবশ্য জেনারেল নুরুদ্দিন খান সেনাপ্রধান হিসেবে ১৯৯০ এর জাতির ক্রান্তিলগ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল মহলের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন। সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থান চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে জেনারেল নুরুদ্দিন এরশাদ সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে স্বৈরশাসনের ইতি ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাকে ফিরিয়ে আনা ত্বরান্বিত করেছিলেন। তখনও জেনারেল এরশাদের প্রতি ব্যক্তি আনুগত্যকারী কয়েকজন জেনারেলকে দিয়ে জেনারেল এরশাদ হয়তো মরণকামড় দিতে পারতেন, কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল নুরুউদ্দিনের সময়োচিত সঠিক সিদ্ধান্ত জাতিকে তখনকার ক্রান্তিকাল অতিক্রমে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে।
২০২৪ পূর্ববর্তী ও ১৯৯০ পরবর্তী বাংলাদেশে জাতির ক্রান্তিলগ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতায় দুইজন সেনা প্রধানের নাম প্রণিধানযোগ্য। অত্যন্ত অবিবেচনা প্রসূত হটকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম ১৯৯৬ সালের ২০ মে তারিখ সামরিক অভ্যুত্থানের পটভূমি সৃষ্টি করে দেশকে একটি বড় ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সময়টা ছিলো বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কেয়ারটেকার সরকারের সময় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন প্রায়। গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশ মাত্র ৫ বছর অতিক্রম করেছে। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের একটি গোষ্ঠীর কথিত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ২/৩ জন ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চাকরিচ্যুত করা হলে জেনারেল নাসিম রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্ত না মেনে রাষ্ট্রপতিকে উৎখাতের জন্য কয়েকটি ডিভিশনকে ঢাকা আসার আদেশ দেন। ৯ পদাতিক ডিভিশন রাষ্ট্রপতির পক্ষ তথা গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার পক্ষ অবলম্বন করে ঢাকামুখী সব রাস্তা বন্ধসহ বঙ্গভবনে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ায় জেনারেল নাসিমের অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু একজন সেনাপ্রধানের এইরকম হটকারী সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। দুই পক্ষের মধ্যে যদি রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষ হতো, তাহলে দেশ কী অবস্থায় যেত তা সহজেই অনুমেয়।
আরেকজন হলেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। ২০০৯ সালের ইতিহাসের ভয়াবহ ও নৃশংস বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বিডিআর সৈনিকরা বিদ্রোহ করলেও এবং ৫৭ জন নিরস্ত্র অত্যন্ত মেধাবী সেনা অফিসারদের হত্যা করলেও, সেনাপ্রধান জেনারেল মইন বিদ্রোহ দমনে ও সেনা অফিসারদের রক্ষায় সিদ্ধান্ত নিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
জেনারেল মইন পরবর্তী সকল সেনাপ্রধানগণ বিগত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত এবং কেউ কেউ পেশাদারিত্বের নিরিখে স্বনামধন্য হলেও জাতীয় গুরুত্ব বা সংকট বিবেচনায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ পাননি বা রাখেননি। আবার কেউ কেউ অনেক বিতর্কিত হয়েছেন। জেনারেল ওয়াকারও বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্বাচিত সেনাপ্রধান। পেশাদারিত্বের নিরিখে ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে তার সেনাপ্রধান হওয়া নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় তারও ‘সরকারের সকল কাজে আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক সেনাপ্রধান’ এর চরিত্র ও ফ্রেমের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু জুলাই-আগস্ট-২৪ বিপ্লবের প্রেক্ষিতে জাতির কঠিন একটি সময়ে দেশে ও জনগণের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত জেনারেল ওয়াকারকে ইতিহাস ইতিবাচক স্থান দেবে বলেই প্রতীয়মান হয়।
বিশেষ করে তার এই সিদ্ধান্তে আবারও প্রমাণ করলেন যে, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশের ক্রান্তিলগ্নে কখনোই জনগণের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়ায়নি।
জেনারেল ওয়াকারের এবারের ভূমিকা ও তার সিদ্ধান্তের অনন্যতা তার জন্য প্রতিকূলতাগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই বোধগম্য হবে। নিচে প্রতিকূলতাগুলো সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক।
• দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের আকস্মিকতা। ১৯৯০ এর মতো এটা সকল বিরোধী দলের সমন্বিত দীর্ঘদিনের আন্দোলন ছিল না। ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে সরকার পতনে রূপ নেবে- এটা অন্য বাঘা বাঘা রাজনীতিক ব্যক্তিরা যেমন বুঝতে পারেনি, তেমনি সেনাপ্রধানও বুঝতে পারেননি।
• জেনারেল ওয়াকারের ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতির প্রতি কতটুকু আগ্রহ আছে জানা না থাকলেও, শেখ হাসিনার ফুপাতো বোনের স্বামী হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের ছায়ায় ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর সময়ে মেজর থেকে প্রত্যেক পদে পদোন্নতি পেয়ে জেনারেল এবং সেনাপ্রধান হয়েছেন। অবশ্যই এই সকল প্রাপ্তির জন্য জেনারেল ওয়াকারের পেশাগত, নেতৃত্ব ও চারিত্রিক যোগ্যতার তেমন কোনো ঘাটতি আছে বলে জানা নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের প্রতি তার ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থাকাটাই অধিকতর যৌক্তিক। আর এই দায়বদ্ধতা সরকারের বিরুদ্ধে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবশ্যই একটি বড় মানসিক প্রতিকূলতা হিসেবে কাজ করেছে বলেই অনুমেয়। এইরকম পারিবারিক দায়বদ্ধতার চাপ অন্য কোনো সেনাপ্রধানের ওপর ছিল বলে আমাদের জানা নাই।
• ৫ আগস্টের আগে থেকেই পুরো সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল, ১৪৪ ধারা জারিসহ সান্ধ্য আইনও প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিছু অপরিপক্ব সেনা অফিসারসহ কিছু সেনা সদস্যদের আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমগুলোতে সমালোচনার ঝড় উঠে। তাছাড়া সেনাবাহিনীও কোথাও কোথাও আক্রান্ত হচ্ছিল। এহেন পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগ তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অনেক কঠিন করে ফেলেছিল।
• শেখ পরিবারের সঙ্গে জেনারেল ওয়াকারের আত্মীয়তার সম্পর্ক সম্পর্কে সকল মহল অবগত থাকায়, জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্যের আন্তরিকতা নিয়ে ছাত্র-জনতাসহ সকল আন্দোলনকারী এবং সকল মহলের মধ্যে সংশয় ও সন্দেহ ছিল।
• সেনাবাহিনীতে ১৫ বছরে দলীয়করণের প্রভাবে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কমান্ডারগণসহ সেনা প্রধানের পিএসও গণ এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানগণের দলীয় আনুগত্য তৎকালীন সরকারের ওপর একটু বেশি থাকাই স্বাভাবিক। তাই সরকারের স্বার্থবহির্ভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষ মতামত পাওয়া নিয়ে যেমন সংশয় ছিল, তেমনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায তারা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারে বলেও ধারণা করা হয়েছিল। তবে এর মধ্যে কেউ কেউ ব্যতিক্রমও থাকতে পারেন।
• দেশের এই ধরনের ক্রান্তিকালে আমাদের জানা-শোনার বাইরেও সেনাপ্রধানের ওপর অনেক দেশি ও বিদেশি শক্তি ও গোষ্ঠীর পক্ষে-বিপক্ষে চাপ বা প্রভাব থাকে।
• আওয়ামী লীগ সরকার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট ছিল। তাই এই সরকারের পতনে পার্শ্ববর্তী দেশটি কী ধরনের ভূমিকা নেয়, এতে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর কোনো হুমকি আসতে পারে কি না- দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে এটা সেনাপ্রধানের জন্য একটা বড় ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
• উল্লেখ্য যে, ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থানের সময় এই বিষয়টি বরং সরকার বিরোধীদের অনুকূলে ছিল।
• এবার সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জটিল বিষয় ছিল সর্বস্তরের সৈনিক এবং জুনিয়র অফিসারদের মন, ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বুঝা। সেনাপ্রধানের ভুল সিদ্ধান্ত বা দীর্ঘসূত্রতা সেনাবাহিনীর ভেতরে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারত। বিশেষ করে ছাত্রদের যৌক্তিক কোটাবিরোধী আন্দোলনে সরকারের অনাকাঙিক্ষত পেশিশক্তির ব্যবহার ও শত শত ছাত্র-ছাত্রীকে হত্যা করার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আরও বলপ্রয়োগে সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আদেশ অমান্য করাসহ চেইন অফ কমান্ড ভেঙে যেতে পারত।
• এই ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হলে সেনাপ্রধানদের যেকোনো মুহূর্তে বরখাস্ত হওয়াসহ বন্দি হওয়ার আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি জীবনের ওপরও হুমকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তমনে কারও সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনার স্বাধীনতাও থাকে না। কারণ তার যেকোনো কথা বা আলোচনা সরকারপ্রধানের কাছে ভুল ব্যাখ্যাসহ মুহূর্তে পৌঁছে যেতে পারে, যার ফলাফল কখনও কখনও সেনাপ্রধানের জন্য বিব্রতকর হতে পারে।
• সরকারবিরোধী অবস্থান বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিপক্ষে তার ওপর পারিবারিক চাপ খুব বেশি ছিল বলেই অনুমেয়। যা অন্য কোনো সেনাপ্রধানকে কোন ক্রান্তিকাল অতিক্রমে হয়তো মুখোমুখি হতে হয়নি।
এতসব প্রতিকূলতার মুখেও, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার জন্য সময় না পেলেও, এত বড় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও জেনারেল ওয়াকার ব্যক্তি বা পারিবারিক স্বার্থের ওপরে উঠে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকালকে উৎরে দেশকে দ্বিতীয স্বাধীনতার স্বাদ দিতে ছাত্র জনতার বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে সহায়তা করেছেন, নতুন করে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর গৌরব ফিরিয়ে দিয়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্বাচিত সেনাপ্রধান এবং সরকার প্রধানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়েও ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে তার ভূমিকাকে ইতিহাস কীভাবে দেখবে সময়ের পরিক্রমায় ইতিহাসই ঠিক করবে। তবে ইতিহাসের পরিক্রমায় এটাও নিশ্চয় মনে রাখতে হবে যে, সেনাপ্রধান সঠিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে থেকে যদি ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিত, তাহলে আমরা হয়তো প্রত্যক্ষ করতাম।
• আরও হাজার হাজার ছাত্র-জনতার শহীদ হওয়া ও হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করা।
• ছাত্র-জনতার মুখোমুখি সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনী বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে সম্ভাব্য রক্তপাত, যা গৃহযুদ্ধের সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারতো।
• বিপর্যস্ত ও অসংগঠিত পুলিশ বাহিনীর মতো বিপর্যস্ত ও অসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীও। যা দেশের শেষ অবলম্বন। এই সুযোগে হয়তোবা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের অনাকাঙিক্ষত হস্তক্ষেপ। বিপর্যস্ত হতো প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা। উল্লেখিত সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিস্থিতিগুলো থেকে দেশকে রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বর্তমান সেনাপ্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের সিদ্ধান্তগুলো দেশ ও জাতির নিরাপত্তা বিবেচনায় কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও কত অনন্য তা নিশ্চয় বোধগম্য। তবে কয়েকটি সিদ্ধান্ত যেমন, শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে দেওয়া, বিতর্কিত ও ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে জড়িত কিছু ব্যক্তিকে সেনানিবাসে আশ্রয় ও পরে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা নিয়ে জনমনের সন্দেহ ও সমালোচনার সদুত্তর হয়ত সময়ই দেবে। তবে আমাদের অপেক্ষা করে দেখতে হবে এর পেছনে জাতীয় নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি ছিল কি না, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সম্ভাবনা কেমন ছিল এবং আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিরাপত্তা আশ্রয়ে থাকা ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা যেত কিনা! মামলা রজ্জু করে ওদেরকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করলেও তাদের নিরাপত্তা দিয়ে আইনের হাতে তাদের সোপর্দ করার জন্য পুলিশ তখন প্রস্তুত ছিল কিনা!
সবশেষে আমি মনে করি যে, দেশবাসী ও সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের ওপর মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত ছিল। তাছাড়া যতটুকু জানি - তিন বাহিনী প্রধানই অত্যন্ত সৎ, পেশাগতভাবে দক্ষ ও যোগ্য, ধার্মিক এবং চারিত্রিক ও নেতৃত্বের গুণাবলিতে বলীয়ান। তাছাড়া এই তিনজন কোর্সমেট ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তাদের মধ্যে বোঝাপড়া খুবই গভীর, যা বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। শেষ করছি পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়ে যে, আমার আজকের আলোচনা ছিল মূলত: জাতির ক্রান্তিকালে একটি ঐতিহাসিক সময়ে বর্তমান সেনাপ্রধানের স্বৈরাচার সরকারের ওপর সমর্থন অব্যাহত না রেখে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের জটিলতা, জাতীয় গুরুত্ব ও সঠিকতা নিয়ে। কিন্তু তার অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের কর্মকাণ্ডের সঠিকতা নিয়ে নয়।