আমরা অনেকেই সমাজকল্যাণমূলক কর্মে নিয়োজিত। দেশব্যাপী এরূপ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সরকারি, বে-সরকারি, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে। আদিকাল হতে পৃথিবীতে সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। যার মূল দর্শন মানবতাবোধ, পরস্পর মমত্ববোধ, স্রষ্টার সন্তুষ্ঠি অর্জন এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা।
দেশে ‘সমাজকল্যাণ’ নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় আছে। এ মন্ত্রণালয়ধীন বিবিধ দপ্তর দেশের অসহায় মানুষের কল্যাণে বিশেষ বিশেষ কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এ দর্শন শক্তিই সমাজের দুঃখী, অসহায় ও সমস্যাগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে মহৎ ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করেছে। ‘সমাজকল্যাণ’ কী? এটি কি কোনও বিশেষ কর্ম, কোনও বিশেষ সেবা, না বিশেষ পেশা, নাকি বৃত্তি। এ প্রসঙ্গে সর্ব সাধারণের ধারণা সুস্পষ্ট নয়। সাধারণ ভাবে বলা যায় মানুষের মঙ্গলার্থে যা করা হয় তাই ‘সমাজকল্যাণ’। যাহা এক মহৎ সেবাকর্ম।
বিজ্ঞাপন
অপরদিকে পেশাদার সমাজকল্যাণ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কর্মকাণ্ডের এক সু-সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। সভ্যতার সূচনালগ্ন হতে মানুষের কল্যাণমূলক প্রচেষ্টা ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং অসংগঠিত উপায়ে। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রভাবে বর্তমান সমাজব্যবস্থা বহুমুখী সংকটে উপনীত। যার উত্তরণ সাধন শুধুমাত্র ব্যক্তি পর্যায়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।
দেশে চলমান পেশাদার সমাজকল্যাণমূল কর্মকাণ্ডসমূহ হচ্ছে: চিকিৎসা সমাজকর্ম, প্রবেশন সমাজকর্ম, পল্লী সমাজকর্ম, প্রবীণ সমাজকর্ম এবং সাধারণ সমাজকর্ম ইত্যাদি।
মানুষ কর্ম নিয়ে বাঁচতে চায়। কর্মক্ষমতা মানুষের বেঁচে থাকার শক্তি এবং জীবন ধারণের জন্য উপার্জন করে। কিন্তু উপার্জনের বৈধ মাধ্যম কী? উপর্জনের যথার্থ মাধ্যম হচ্ছে হয় শারীরিক শ্রম কিংবা মানসিক শ্রম। শুধুমাত্র শ্রমের বিনিময়েই মানুষ উপার্জন করতে পারে। মানুষ উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সন্ধান করে ব্যক্তিগত শিক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও শারীরিক সক্ষমতার ভিত্তিতে। প্রত্যেকে চায় শোভন, বৈধ ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মক্ষেত্র। মানুষ যে কর্মের মাধ্যমে জীবীকা নির্বাহ করে, তা ঐ ব্যক্তির বৃত্তি বা পেশা। আবার পেশা বা বৃত্তি বাছাই করার ক্ষেত্রে পদ মর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা ও উপার্জন করার ক্ষমতা বিবেচনা করে। ‘বৃত্তি’ হচ্ছে জীবনধারণের উপায়। যে ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। আবার পেশা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট শিক্ষা, বৈশিষ্ট্য, নৈপুন্যতা ও দক্ষতার সমষ্টি। এ ক্ষেত্রে বিশেষ নীতি ও মূল্যবোধ অনুসরণ করতে হয়। দেশে পেশাদার শ্রমশক্তির হার সংকট প্রকট। বর্তমানে অনেক মানুষ ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় কর্মসংস্থানের তাগিদে ‘সমাজকল্যাণ’কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে। কিন্তু মানবিক পেশা হিসেবে ‘সমাজকল্যাণ’ কে ধারণ করার জন্য দরকার মানসিক প্রস্তুতি। প্রয়োজন সমাজকল্যাণমূলক ধ্যান, জ্ঞান ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী
মানুষ কেন হিতকর কাজ করতে চায়! এর মূল দর্শন কী? সাধারণত মানুষ ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মানবকল্যাণে তাড়িত হয়ে কল্যাণকর কাজ করে। এ দেশের মানুষ সুদীর্ঘ কাল হতে ব্যক্তিক পর্যায়ে সমাজকল্যাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজকর্মের বিবর্তন ঘটে ব্রিটিশ শাসনের শেষ ভাগে। ‘ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তির আশ্রয় আইন-১৯৪৩’ প্রবর্তনের মাধ্যমে। এরপর প্রবর্তিত হয় ‘বিধবা ও শিশুসদন আইন-১৯৪৪’। যার বিশেষ লক্ষ্য ছিল দেশের বিধবা ও এতিম শিশুদের সুরক্ষা। ভারত বর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত ফসল ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত স্বাধীনতা। দেশ বিভাজন পরবর্তী এ দেশে দেশত্যাগীদের (মহারেজ) আগমন ঘটে। উদ্ভব ঘটে নগর কেন্দ্রীক সংকটের। এ সংকট উত্তরণে তৎকালীন সরকার জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করে। দেশে জাতিসংঘের ৩ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ টিম আগমন ঘটে। বিশেজ্ঞ টিম সার্বিক অবস্থা অনুধাবন করে এবং সমষ্টিভিত্তিক কর্মসূচি চালু ও পেশাদার সমাজকর্মী তৈরির সুপারিশ করেন। এ প্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালে এ দেশে সমাজকল্যাণ শিক্ষার যাত্রা শুরু। জাতিসংঘের সহায়তায় আরম্ভ হয় একটি স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ কোর্স। বিশেষজ্ঞ টিমের সুপারিশক্রমে ১৯৫৩ সালে চালু করা হয় ঢাকার কায়েতটুলী এবং করাচির লাখারী এলাকায় ‘শহর সমষ্টি উন্নয়ন’ নামক কর্মসূচি। সমাজকর্ম বিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে ‘সমাজকল্যাণ ও গবেষণা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় সমগ্রদেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রায় ৫৪টি মানবসেবামূলক কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। প্রসার ঘটে সমাজকল্যাণ শিক্ষার। বর্তমানে দেশের ৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রায় ৫৮টি কলেজে সমাজকর্ম/সমাজকল্যাণ বিষয়ে ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বব্যাপী সমাজকল্যাণ সেবার সূচনা মানবহিতৈষী দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার মাধ্যমে। পরবর্তীতে সমাজকল্যাণমূলক সেবাকে পেশাগত প্রক্রিয়ায় রূপান্তর এবং এ বিষয়ে একটি শিক্ষাগত কাঠামো গঠনের জন্য সমাজকর্ম ধারণার উদ্ভব। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড এর রাজত্বকালীন প্রণীত ‘দরিদ্র আইন-১৩৪৯’ সমাজকল্যাণ কর্মসূচি প্রবর্তনে অনন্য অবদান রাখে। পরবর্তীতে ১৬০১ সালের এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইন সমাজকল্যাণ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ আইন দারিদ্রের প্রতি রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের সম দায়-দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে ইংল্যান্ডে সমাজকল্যাণ বিকাশে ‘বসতি আইন-১৬৬২’, ‘দরিদ্র সংস্কার আইন-১৮৩৪’ এবং ১৯৪২ সালে স্যার উইলিয়াম বিভারিজ কর্তৃক প্রবর্তিত ‘সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ বিশেষ অবদান রাখে।
সমাজকল্যাণের উৎপত্তি ও প্রারম্ভিক বিকাশে ঐতিহাসিকভাবে ইংল্যান্ডের গৃহীত উদ্যোগ অনন্য। তবে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশে আমেরিকার ভূমিকা অতুলনীয়। আমেরিকায় প্রচলিত উল্লেখযোগ্য সমাজকল্যাণ কর্মসূচি হলো: শ্রমাগার, অনাথ আশ্রম, সরকারি মানসিক হাসপাতাল, দানশীল সমিতি, পেনসিলভেনিয়া হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা। ইংল্যান্ডের অনুকরণে (‘Charity Organisation Society’-COS) প্রতিষ্ঠা সমাজকর্মকে পেশাগত মর্যাদায় রূপদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমেরিকায় সমাজকল্যাণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে পেশাগত প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৮৯৩ সালে শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রখ্যাত সমাজকর্মী এনা এল ডয়েস সমাজকর্ম বিষয়ে পেশাগত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এ ধারাবাহিকতায় ১৯০৪ সালে পেশাগত শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয় (New york School Of philanthropy ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যাহা পরবর্তীতে (New york School Of Social Work) উন্নীত হয়। যেকোন পেশার মান উন্নয়নে পেশাগত সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজকর্মকে পেশাগত রূপদানের ক্ষেত্রে ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত (The National School of Social Workers Exchange) এর ভূমিকা অত্যাধিক। এ প্রেক্ষিতে গড়ে উঠে অনেক পেশাজীবী সংগঠন। সমাজকর্মীদের পেশাগত মানোন্নয়ন ও সমাজকর্ম পেশার মর্যাদা রক্ষার ১৯৫৫ সালে গড়ে উঠে জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি (National Association of Social Workers (NASW))। এ সংগঠন সমাজকর্ম অনুশীলনের (Code of Ethics) প্রণয়ন করে। এ সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৬১ সাল হতে পেশাদার সমাজকর্মীদের নিবন্ধন, লাইসেন্স ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
পেশা হচ্ছে কর্মসংস্থান বা জীবন ধারণের ভিত্তি। যখন কোনও ব্যক্তি তার বিশেষ জ্ঞান, দক্ষতা ও কলাকৌশল জীবন ধারণের উপায় হিসেবে প্রয়োগ করে, তখন ঐ কাজ পেশা হিসেবে গণ্য হয়। বাংলাদেশে ডাক্তারী, শিক্ষকতা, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ওকালতী পেশা হিসেবে বিবেচিত। পেশাগত স্বীকৃতির জন্য পেশার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। যথা: অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে ডিগ্রী অর্জন, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, পেশাদার সংগঠন হতে স্বীকৃতি অর্জন ও পেশাগত নৈতিক মানদণ্ড অনুসরণ। সমাজকল্যাণ হচ্ছে বিশেষ সেবাকর্ম। যাহা মানুষের আবেগ, অনুভূতি, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, হতাশা, দুর্দশা ও বঞ্চনা নিয়ে কাজ করে। যাহা পেশাগত ধারণা, প্রশিক্ষণ ও পেশাগত মনোবৃত্তি ছাড়া যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম দর্শন হচ্ছে: মানবকল্যাণ, জনসমর্থন ও জনসন্তুষ্টি। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার দেশের অসহায়, নিগৃহীত ও বিপন্ন মানুষের তরে বহুমুখী কল্যাণধর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে: বিদ্যমান সমস্যার প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। আধুনিক সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড সুসংগঠিত ও সু-প্রতিষ্ঠিত। যাহা সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের আদিরূপ পরিহার করে সাংগঠনিক আকার ধারণ করেছে। একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্র সমাজকল্যাণ নীতি ও পরিকল্পনার আলোকে বঞ্চিত,অনগ্রসর, সমস্যাগ্রস্থ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক পৃথক কর্মসূচি প্রবর্তন করছে। সুনিদ্রিষ্ট পদ্ধতি ও বৈশিষ্ট্য অনুসরণক্রমে কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য সফল হবে। সমাজকল্যাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে আদর্শ মানদন্ডসমূহ অনুসরণ করলে সেবাগ্রহীতার পরিতৃপ্তি সুনিশ্চিত হবে। বৃদ্ধি পাবে পেশাগত মর্যাদা। তাই দেশব্যাপী সমাজকল্যাণ কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নে চাই আদর্শ মানদণ্ড অনুসরণ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজকল্যাণমূলক কর্মের পেশাগত মর্যাদা ও পেশাগত স্বীকৃতি। পেশাদার সমাজকর্মীরাই পারে সমাজকল্যাণ কর্মকে একটি সমৃদ্ধ পেশা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। সমাজকল্যাণ কর্ম হোক একটি স্বীকৃত পেশা ও একটি মর্যাদাপূর্ণ কর্ম। সমাজকল্যাণমূলক পেশা হোন তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণীয় কর্মক্ষেত্র। চাই সমাজকল্যাণ কর্মের পেশাগত স্বীকৃতি।

