রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বাংলাদেশে বন্যা: কারণ, প্রভাব ও উত্তরণের উপায়

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০১:১১ এএম

শেয়ার করুন:

বাংলাদেশে বন্যা: কারণ, প্রভাব ও উত্তরণের উপায়

বন্যা হলো এমন এক পরিস্থিতি যেখানে জল উপচে পড়ার কারণে সাধারণত শুষ্ক জমি নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং জনজীবনের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়। বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যাগুলো বন্যার কারণগুলোকে প্রভাবিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যার তীব্রতা এবং ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন উজাড়, জলাভূমি অপসারণ, জলধারার গতিপথের পরিবর্তন বা বাঁধ নির্মাণ তীব্র বন্যার অন্যতম কারণ।

বর্তমান বন্যায় বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ ১১ জেলার ৭৪টি উপজেলার অর্ধকোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৩ জন মারা গেছেন, এবং নিখোঁজ রয়েছেন অনেক। তবে, এবারের বন্যায় দেশের যুবসমাজ এবং শিক্ষার্থীরা ত্রাণ-সহায়তা এবং উদ্ধার কাজে বিরল সাড়া দিয়েছে। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, এবং বিভিন্ন এনজিও ও প্রতিষ্ঠান সহায়তা এবং উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ুপ্রবাহও পরিবর্তিত হয়। শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এবং বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়। সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষে সূর্য দক্ষিণ দিকে সরে যায় এবং নভেম্বর থেকে হিমালয়ের শুষ্ক ও ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়, যা উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত। অন্যদিকে, বর্ষাকালে মে মাসের শেষ দিকে মৌসুমি বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তরের দিকে প্রবাহিত হয়, যা হিমালয় পর্বতমালার দিকে প্রচুর জলীয় বাষ্প নিয়ে আসে। এই কারণে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ বর্ষাকালে ঘটে। বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর পানি বাড়তে শুরু করে এবং নিচু এলাকায়, যেমন হাওর, বিল, ঝিলগুলো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং, বর্ষা ঋতুতে বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। পানি যখন নদীর তীর বা বাঁধ উপচে প্লাবন ভূমিতে ঢুকে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, তখন সেই অবস্থাকে বন্যা বলা হয়। পানি যে উচ্চতায় উঠে ফসলি জমি বা ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই উচ্চতাকে বিপৎসীমা হিসেবে ধরা হয়।

বাংলাদেশে বন্যাকে সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা যায়— ১. মৌসুমি বন্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টিপাতের কারণে প্রধান নদীগুলো ও তাদের শাখা নদীগুলোতে পানি বাড়ে এবং তীর বা পার্শ্ববর্তী বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ২. আকস্মিক বন্যা: দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি নদীগুলোতে আকস্মিক বন্যা হয়, যা দ্রুত পানি বৃদ্ধি এবং হ্রাস পায়। পাহাড়ি এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হয়। ৩. বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা: দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত ও পানিনিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনার কারণে হয়, যা শহর এলাকায়ও দেখা যায়। ৪. উপকূলীয় বন্যা: উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল ও মোহনায় জোয়ার এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়া বা জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে নিয়মিত বন্যা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ হিমালয় থেকে উৎসরিত তিনটি বৃহৎ নদী: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলল দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। এটি পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভাটির দেশ এবং নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশের মোট নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৫টি। গবেষকদের মতে— এটি প্রায় ৭০০টি। সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। দেশের দীর্ঘতম নদী তিনটি: পদ্মা (৩৪১ কিমি.), উছামতি (৩৩৪ কিমি.) এবং সাঙ্গু (২৯৪ কিমি.) এবং ক্ষুদ্রতম নদী তিনটি: গাঙ্গিনা (০.০৩২ কিমি.), কলমদানী (০.০৪২ কিমি.) এবং ইটবাড়িয়া (০.১০০ কিমি.)।

প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণে নদীগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নদীগুলোর বিপর্যয় মূলত তিন কারণে হচ্ছে: ভারতের একতরফা আগ্রাসী তৎপরতা, বাংলাদেশের নদী-বিপর্যস্ত উন্নয়ন কৌশল, এবং নদী দখলদারদের সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতার যোগসাজশ। বন্যার কারণ হিসেবে বলা যায়, ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ভাটিতে হওয়ায় বন্যার প্রবণতা বেশি। দেশের নদীগুলোর বিলুপ্তি, নাব্যতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, উজানের বৃষ্টির জলধারা, এবং মানবসৃষ্ট অব্যবস্থাপনাই বন্যার কারণ।


বিজ্ঞাপন


ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে গঙ্গা, ইছামতি-কালিন্দী, রায়মঙ্গল, বেতনা-কোদালিয়া, ভৈরব-কপোতাক্ষ, মাথাভাঙ্গা, পাগলা, আত্রাই, পুনর্ভবা, তেঁতুলিয়া, টাঙন, কুলিক বা কোকিলা, নাগর, মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, ঘোড়ামারা, দেওনাই-যমুনেশ্বরী, বুড়ি তিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম, চিল্লাখালী, ভোগাই, নিতাই, সোমেশ্বরী, জাদুকাটা, ধামারিয়া-জাদুখালী, নওয়াগাং, উমিয়াম, ধলা, পিয়াইন, সারি-গোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই-বরদল, জুরি, মনু, ধলাই, লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতি, কাকরাই-ডাকাতিয়া, সিলোনিয়া, মুহরী, ফেনী ও কর্ণফুলী। এই নদীগুলোতে বাঁধ, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প, রিজার্ভার নির্মাণের ফলে পানির প্রবাহ আটকে রেখেছে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানিতে বন্যা হয়।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়
১. আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীনের পানি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক পানি ফোরাম গঠন করতে হবে। ২. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে হবে এবং ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। ৩. চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা ব্যারেজের পানির হিস্যা নজরদারীতে রাখতে হবে। ৪. নদী দখল, নদীর তীর ঘেঁষে অবৈধ দখল, ময়লা ডাম্পিং, অবৈধ বালু উত্তোলন এবং অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ৪. নদীর নাব্যতা বাড়াতে বড় নদী, হাওড়, জলাশয়ে জলাধার তৈরি করতে হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে কৃষি ও সেচ কাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে এবং তৃতীয় পক্ষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ৬. আন্তর্জাতিক ফোরামে তথ্য ও উপাত্তসহ প্রভাব উপস্থাপন করতে হবে। ৭. কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং সরকারের পাশাপাশি সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ ও প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ৮. পানি রাজনীতি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে জোরদার করতে হবে এবং গঙ্গার পানিবণ্টনের সাথে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদীর বিষয় আলোচনায় আনা উচিত। ৯. দেশের উজানে বনায়ন, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং চাষাবাদে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ১০. বন্যা মোকাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধি, জরুরি ব্যবস্থাপনা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বন্যার ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
 
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
গাজীপুর-১৭০১। 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর