ভাষা আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাঁক-বদলের ইতিহাস। কিন্তু ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান যারা দেখেননি তারা ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান পর্যবেক্ষণ করেছে। ছাত্রদের আন্দোলন কখনো বিফলে যায়নি। যেমনটি হয়েছিল ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়। তারা দেশ স্বাধীন করেই ঘরে ফিরেছিল।
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে কম নয়। এবারে ছাত্র-জনতা লড়েছে ফ্যাসিবাদী এক শক্তির বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ভোট কারচুপির মাধ্যমে দেশে স্বৈরাচারী শাসন চালিয়ে আসছিল। দুর্নীতি, ধর্ষণ, রাহাজানি, বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, চাঁদাবাজি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ এমন কোনো কাজ নাই যেটা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন করেনি। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস দেখাতো না। দেশের সাধারণ মানুষ বাকস্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছিল। এটাকে কি গণতন্ত্র বলা যায়? ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদও আত্মদানের বিনিময়ে আমরা কি এই দেশ চেয়েছিলাম?
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে যারা ছিল তারাও যে ধোয়া তুলসী পাতা ছিল তা নয়। কিন্তু বিএনপি আমলের যত অপকীর্তি সব ভুলতে হয়েছিল আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কারণে। আসলে আমরা বাঙালি জাতি খুবই সহজ-সরল। তারা অতীতের কোনো কথাই মনে রাখতে চায় না বা রাখে না। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছিল যুদ্ধের মাস। বাঙালি জাতি আর একবার স্বাধীনতার স্বাদ পেল। আর একবার তারা নতুন যৌবন ফিরে পেল আওয়ামী লীগের পতনের মধ্য দিয়ে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেননি। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো দেশত্যাগ করে। বাংলাদেশে প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় ২০১৮ সালে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলন।
প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনা লগ্নে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বপ্রথম কোটাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় ১৯৭২ সালে। এই কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরিপ্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। লাগাতার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ সরকার। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোটার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে ২০১৮ সালেই সমাধান হতে পারত। তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কার। কিন্তু তা না করে যেভাবে পুরোপুরি বাতিল করা হয়, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে বিষয়টি পুনরায় সংকট তৈরি করতে পারে। হলোও তাই। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে রায় দেন। আগের মতো কোটা চালু হওয়া মানে মেধাবীরা বৈষম্যের শিকার হবেন। সে জন্যই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন— ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘একাত্তরের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’।
কোটা কত বড় বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোটার আক্ষরিক অর্থ নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত। কোনো একটি জনসমাজ বা রাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শাসন কার্যে অন্তর্ভুক্ত করাসহ জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রাধিকার দিতেই এই ব্যবস্থার আবির্ভাব। উন্নত, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীর কোনো বিকল্প নেই। নিঃসন্দেহে স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে আবেগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মেধাবীদের সুযোগ না দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিজ্ঞাপন
ছাত্রদের এই আন্দোলন নিঃসন্দেহে যৌক্তিক। বর্তমান সময়ে আন্দোলনের তীব্রতা দেখে এটি সহজে অনুমান করা যায় যে, মেধাবী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনটিকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে। দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীদের গৃহীত কর্মসূচি থেকে এটি স্পষ্ট যে, মানুষ মেধাভিত্তিক সমাজ চায় এবং এই ন্যায্য দাবি আদায়ের শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতেও তারা কুণ্ঠিত নন। দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও মতামত প্রকাশ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।
এখন প্রশ্ন হলো বৈষম্য মুক্ত, মেধাভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে কোটা থাকলে কি সুবিধা পাবে এবং না থাকলেই বা এর অসুবিধা কতটুকু?
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের দুটি কথাই কাল হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগের জন্য। শুরু হয় সহিংস আন্দোলন। পুলিশের গুলিতে প্রথম রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ মারা যান। এতে করে সারা দেশে কোটা আন্দোলনকারী ছাত্ররা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে এদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবক, ডাক্তার, দিনমজুর, রিকশাওয়ালাসহ আরও অনেকে। প্রাণহানি ঘটে শিশু, ছাত্র, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, পথচারীসহ বহু লোকের। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় সারা বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গোয়ার্তুমির জন্য ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে নিজেকে আর বাঁচাতে পারলেন না। শেষমেশ ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে হলো বিদেশে।
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে এখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। তবে এই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের পরিকাঠামো কীভাবে হবে তা নিয়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা চাচ্ছেন নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেখানে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করতে পারবে। সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের কাজ করবে এবং সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে।
মূল কথা হলো— তারা কি পারবেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সিন্ডিকেট ভাঙতে? সাধারণ মানুষ একটু শান্তি চায়, স্বস্তি চায়। এই গণঅভ্যুত্থানে সেই সংকট যুক্ত হয়েছিলো। মানুষকে একটু শান্তিতে রাখতে তার রুটি-রুজির কথা ভাবতে হবে। সাধারণ মানুষের মুক্তি তার রুটি-রুজির মধ্যে নিহিত। সেটা ভাবতে হবে সবার আগে। এছাড়া মানুষকে অভুক্ত রেখে যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করেছে তাদের টাকা ফেরত আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট, হিংসাত্মক ঘটনা বন্ধে কঠোর হতে হবে। সুযোগ সন্ধানীদের সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর লুটপাট বন্ধে কঠোর হতে হবে। সর্বোপরি দেশের এই গণঅভ্যুত্থানে যত লোক মারা গেছে, সেসব খুনি অপরাধীদের আইনের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে সার্থক হবে এতদিনের একটি সফল অভ্যুত্থান।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

