শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ গাফফার চৌধুরী

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ২২ মে ২০২২, ১২:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ গাফফার চৌধুরী

এক.

দ্বিপ্রহর তখন। অফিসে ঢুকতেই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলো—‘সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী আর নেই।’জানতাম গাফফার চৌধুরী অসুস্থ, বেশ কিছুদিন ধরেই হাসপাতালে আছেন—তবু তার এই চিরপ্রস্থানের খবর বিশ্বাস হচ্ছিল না। কয়েক দিন আগে তার এক কন্যার মৃত্যু হয়েছে। একদিন ফোনে, কন্যার কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন, ‘আমিও বুঝি আর বেশি দিন বাঁচব না।’চেয়েছিলাম, ‘সেঞ্চুরি করবেন গাফফার ভাই। ইতিহাস তার কাঁধে যেসব দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তার সবগুলো তো এখনও শেষ করেননি তিনি।’ আর ক’টা দিন বাঁচলে কী হতো!


বিজ্ঞাপন


গাফফার চৌধুরীকে স্বচক্ষে দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে। তারপরও বললেন, ‘বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগে। আমার সমবয়সী কিংবা আমার থেকে বয়সে ছোট অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে স্মৃতি হাতড়াই আর ভারাক্রান্ত হই।’ হয়তো তার এ চিন্তা আজকাল আমাদের কারও কারও মনে গ্রোথিত হচ্ছে। মৃত্যু চিন্তা আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে যায়। নানান ঘটনায় আমাদের ঘিরে ফেলছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার মনে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে বলেও মনে হলো। বললেন—‘আওয়ামী লীগ পথ হারিয়েছে...।’ এ-কথা বলার সাহসও তার ছিল। এও বললেন-‘বাম রাজনীতিটাও দিকবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা তাদের লক্ষ্য থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে।’বাম রাজনীতির প্রতি তার সমর্থন ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার দ্বিমত ছিল। তাতে বিদ্বেষ ছিল না। তার বড় প্রত্যাশা ছিল, চেয়েছিলেন বাম রাজনীতি প্রগতিধারাকে শক্তিধর করুক। দ্বিধা-বিভক্ত ছাড়াই বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিক। 

‘আগাচৌ’। সংক্ষেপে তাকে এ নামে বেশি পরিচিত তিনি। এ নিয়ে তার কোনো খেদ ছিলো না। তাকে নিয়ে অনেকের অনেক রকম মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সমালোচনাও আছে। সেটাকে বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করার গুণ সবার থাকে না। আগোচৌ-র ছিলো। কিন্তু অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে যে কলম হাতে নিয়েছিলেন গাফফার চৌধুরী, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালেও তা অব্যাহত রেখেছিলেন। সারাজীবন সোচ্চার এমন কলম সৈনিক জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন। তার আরও একটি দিক আড়ালে থেকে গেছে, একজন মানুষ হিসেবে তার ‘মানবিক’ বোধ। এ বিষয়টা তিনি কখনো বাইরে আনেননি। কিংবা অযাচিতভাবে তাকে মাতামাতি তিনি পছন্দ করতেন না। 

দুই.


বিজ্ঞাপন


আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের প্রজন্ম, কিংবা তার আগের ও পরের প্রজন্মও যাকে জানতেন গাফফার ভাই হিসেবে, কারও কারও কাছে ‘গাপ্পু’ ভাই। তার মৃত্যু সংবাদটা দেশের জন্য শোক এবং বেদনার। সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি লন্ডনে থাকতেন, মাঝেমধ্যে দেশে আসতেন। তার মননে, চিন্তায় বাংলাদেশ চিরন্তন ছিল। গুরুতর অসুস্থ হওয়া আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত লিখতেন। তিনি বলতেন— ‘তার সকাল হতো লেখা দিয়ে, আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগেও লিখতে হতো’। অর্থাৎ পুরোদস্তুর লেখক ছিলেন তিনি। 

এখনকার প্রজন্ম হয়তো আবদুল গাফফার চৌধুরীকে জানেন একজন কলাম লেখক বা সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কলেজে ছাত্রাবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, জেল খেটেছেন। আবার ভাষা শহীদদের স্মরণে লিখেছেন অমর পঙতি—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি’। এই গানের কথা ও সুর এতোটাই মানুষকে আন্দোলিত করেছে যে তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।

তিনি যদি আর কিছু না লিখতেন, এই একটি গান তাকে শতাব্দী পেরিয়েও বাঁচিয়ে রাখবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে মিছিলে মুসলিম লিগ সরকার গুলি চালিয়ে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত প্রমুখকে হত্যা করে, সেই মিছিলে গাফফার চৌধুরীও ছিলেন পেছনের সারিতে। তাই অগ্রভাগে যারা গুলিবিদ্ধ হন, তিনি তাদের দেখতে পাননি, পরে দেখেছেন। একুশের স্মৃতিচারণা নিয়ে লিখেছেন—

আমরা আউটডোরে সামনে গিয়ে দেখি একটি লাশ পড়ে আছে। সাদা প্যান্ট পরা, সাদা শার্ট গায়ে, পায়ে জুতোও আছে, গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে গেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় লাশটি পড়ে আছে। সেই লাশটি দেখার জন্য শত শত লোক ভিড় জমিয়েছে। রফিকুল ইসলাম সম্ভবত তার ছবি নিয়েছিলেন। পরে জানলাম যে এই লাশ হুবহু শহীদ রফিকউদ্দিনের। এই লাশটি দেখার সময়ে আমার মনে কবিতা লেখার জন্য একটি ভাবের উদয় হয়েছিল। ভাবটি এসেছিল কবিতা লেখার জন্য, গান রচনার জন্য নয়। আমি গান লিখতে জানি না, আমি সুরকারও নই, গীতিকারও নই, একটি কবিতা লেখার জন্য আমার মনে যে লাইনটি এসেছিল, তা হলো, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি?’  (নেপথ্য কাহিনী: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি : লুৎফর রহমান রিটন সম্পাদিত, আগামী প্রকাশনী)

আবদুল গাফফার চৌধুরীর অমর গানটি প্রকাশিত হয় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন-এ, ১৯৫৩ সালে। এর আগেই গাজীউল হক ও আবদুল লতিফ একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মরণে দুটি গান লিখেছিলেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে শুধু শহীদদের প্রতি শোকগাঁথা বা আহাজারি নয়, এই গানটিতে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াই-সংগ্রামের কথা আছে, আছে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা প্রকাশ আর নিপীড়িত মানুষের ক্ষুদ্র শক্তিকে জাগানোর উদীপ্ত আহ্বান।

এই গান কেবল আবদুল গাফফার চৌধুরীর কিংবা সুরকার আলতাফ মাহমুদকেই অমর করেনি, বাঙালি চেতনাকেও করেছে তীক্ষè ও শাণিত। আমরা প্রতিবছর একুশে প্রভাতফেরিতে এই গান আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই।

তিন.

গাফ্ফার চৌধুরীর নাম প্রথম শুনেছি তার অমর সৃষ্টি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’র মাধ্যমে। একমাত্র এই গানটিই পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট। খুব গুরুগম্ভীর বাণী নয়, সাধারণ সব শব্দ, সবাই বুঝতে পারেন, প্রতিটি শব্দের অর্থ কম লেখাপড়া জানা মানুষও বুঝতে পারে। এই গান বা কবিতা গাফ্ফার চৌধুরীকে অমর ও স্মরণীয় করে রাখবে বাঙালির মনে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’র পর সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা গানের তালিকায় আছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’গানটি। গানটি প্রথম সুর দিয়েছিলেন আবদুল লতিফ। পরে তা কিংবদন্তি সুরকার আলতাফ মাহমুদের সুরে সবার মনপ্রাণ কেড়ে নেয়। ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে প্রথমবারের মতো আলতাফ মাহমুদের সুরের গানটিই গাওয়া হয়। গানটি লেখা হয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিতে কবিতা হিসেবে, যা ছিল ৩০ লাইনের। পরবর্তীতে এই কবিতার প্রথম ছয়টি লাইনই গান হিসেবে গাওয়া হয়। গানটির জন্ম-গল্প শুনলে শিউরে উঠতে হয়।

একুশের এই গান আজ আর কেবল বাংলাদেশের গান নয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কোর এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রে গাওয়া হয় এই গানটি। বর্তমানে এই গানটি ইংরেজি, হিন্দি, মালয়, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।

যতোদিন প্রভাতফেরি হবে, ততোদিন আপনার গান গেয়ে হবে। গাফফার চৌধুরী এমন গৌরবের কথা নিশ্চিত জেনেই তো গেছেন। ক’জনের এমন ক্ষমতা আর এমন ভাগ্য হয়!

চার.

গাফফার চৌধুরী আরও কিছু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। যদি রাজনৈতিক কলাম লেখা নিয়ে মেতে না উঠতেন, তাহলে বাংলা গদ্য সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারতেন গাফফার চৌধুরী। সেদিকে খুব একটা মনোযোগ তিনি দেননি। হয়তো অবহেলা করেছেন।

পাঁচ.

গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় আমার শৈশবে, সবেমাত্র পত্রিকা পড়া শুরু হয়। খুব বেশি জানতাম না তাকে। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম তার লেখার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। আমার মনে পড়ে ‘একুশে বটতলা’নামে তার ধারাবাহিক কলাম ছাপা হতো। স্কুল জীবনে বোধহয় গাফফার ভাইয়ের লেখাগুলো গ্রোগাসে গিলতাম। লেখার মধ্যে মাদকতা ছিলো, যুক্তি ছিলো, খণ্ডন ছিলো, স্পষ্টতা ছিলো, তথ্য ছিল। রেশ ছিল ভীষণ।

ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা, চরিত্র দিন-তারিখ মনে রেখে বর্ণনার অসামান্য গুণের অধিকারী ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি চলমান ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ ছিলেন রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয়ে। ইতিহাস যেনো ঠোঁটস্থ ছিল, কণ্ঠস্থ ছিল তার। প্রতিটি সময়, সবকিছু চমৎকারভাবে তিনি বর্ণনা করতে পারতেন, বলতে পারতেন। পুরনো ঘটনা দিন-তারিখ দিয়ে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে কীভাবে বলতেন, তা আজও বিস্ময়কর।

লেখাগুলো আমাকে শাণিত করেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে। একদা তার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে জাগিয়েছে, আমিও কলাম লিখব। তার ‘চলে যাওয়া’আমার কেবলই আশ্চর্য করছে, একটা মানুষ কীভাবে আমাকে তৈরি করে দিল, লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিল। কলাম লেখা শুরু করেছি, যেদিন তার লেখার নিচে বা পাশাপাশি আমার লেখা ছাপা হয়েছে, আপ্লত হয়েছি, ভীষণরকম রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল, হয়তো কোনো লেখা দিয়ে তা বোঝাতে পারব না। কতোবার-কতোদিন আমি ওই পাতাটা উল্টিয়েছি, বিশ্বাস করতে পারিনি, তার লেখার পাশে আমার লেখা! এটা ভাবতে গেলে আমি অগোছালো হয়ে যাই।

বড় হতে হতে তার চিন্তার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছে। তার লেখাগুলোর মধ্যে বহুমাত্রিকতা হারিয়ে ফেললাম। বলা চলে ‘যৌবন’হারিয়ে গেছে। ‘পক্ষপাতদুষ্ট’হয়েছেন। কিন্তু সব সময় তাকে অনুভব করেছি। কথা ছিল, তার একটা লম্বা আড্ডা হবে। না, কথা রাখতে পারলেন না গাফফার ভাই। গাফফার ভাই কী এক দীর্ঘ অপেক্ষায় রেখে চলে গেলেন। সেই খেদ থেকেই গেল।

বর্ণাঢ্য, কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি বলে আসলে কিছু নেই। প্রতি বছর সারাদেশের মানুষ গাইবে যার লেখা গান, নীল গগনের বসনে শীতের শেষে, তাকে আর বিদায় বলি কীভাবে! আপনি আসলে থেকে যাবেন বাংলার সঙ্গে, এর পথে-প্রান্তরে, রজনীগন্ধা আর অলোকনন্দার প্রভাতফেরির অরুণ আলোয়... কী করে ভুলি?

আমি কি ভুলিতে পারি?

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর