বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

চলন্ত ইতিহাসের বিদায়

বারেক কায়সার
প্রকাশিত: ১৯ মে ২০২২, ১০:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

চলন্ত ইতিহাসের বিদায়
ছবি: সংগৃহীত

তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। উলানিয়া বাজারে এক চাচার দোকানে নিয়মিত জাতীয় পত্রিকা আসে। আমি স্কুলের লেইজার টাইমে সেই পত্রিকা পড়তে যেতাম। ভালো লাগতো নতুন বিষয়ে পড়তে। ভালো লাগতো নতুন পত্রিকার গন্ধ।

একদিনের পত্রিকায় আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটা কলাম ছিল। সেটাতে তিনি যেটি বলতে চেয়েছিলেন সেটি অনেকটা এমন, প্রথম জীবনে অনেক লেখা লিখতে গিয়ে তিনি ভাবতেন- লোকে কী বলবে? সমালোচকরা কী ভাববে?


বিজ্ঞাপন


তারপর তিনি লিখলেন, এমন ভাবনা ছিল তাঁর জীবনের সেরা ভুল। তিনি লিখলেন, তাঁর লেখায় কেউ প্রশংসা করলেও কিছু যায় আসে না। সমালোচনা করলেও কিছু যায় আসে না। তিনি যা, তিনি তা। সেই থেকে আমার জীবন দর্শন হয়ে উঠে এই বাণী।

আমি আবদুল গাফফার চৌধুরীর এলাকার সন্তান- এই পরিচয় দেই সবসময়। এটাতে আমি আরাম বোধ করি, সম্মানিত বোধ করি। তিনি যখন উলানিয়াতে আসতেন তখন তাঁর বাল্যবন্ধুদের যারা বেঁচেছিল, তাদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে আড্ডা দিতেন। এই গল্প বড়োদের কাছে শুনে মুগ্ধ হয়েছি।

পিআইবিতে কাছ থেকে একবার দেখেছিলাম। তখন কথা হয়নি। তাতে কী? তিনি আমার ভাবনায় আছেন, থাকবেন বহুদিন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার পাঠ নিয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, আমার এলাকার সন্তান আবদুল গাফফার চৌধুরীকে দেখেই সাংবাদিকতা পড়তে এসেছি!

দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখতেন তিনি। রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে তাঁর লেখা কলাম বেশ পাঠকপ্রিয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতো।


বিজ্ঞাপন


‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- এই কবিতা আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। দেশে তখন ভাষা আন্দোলন চলছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাস্তায় তখন আপামর জনতা। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চলে সেই আন্দোলনে। প্রাণ হারান রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতরা।

সেই দিনের সাক্ষী আবদুল গাফফার চৌধুরী। গাফফার চৌধুরী শহীদ রফিকের মরদেহ দেখেছিলেন। পুলিশের গুলিতে রফিকের মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ তিনি। রফিকের মরদেহ দেখে গাফফার চৌধুরীর মনে হয়েছিল, যেন তার নিজের ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে। তখনই তার মনে গুনগুনিয়ে ওঠে একটি কবিতা, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।

সেই কবিতা পরে গানে রূপ নেয়। সেই কবিতায় প্রথমে আব্দুল লতিফ সুর দেন। তারপরে আলতাফ মাহমুদ সুর দেন। এই সুরেই এটা প্রভাত ফেরির গান হয়ে উঠে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটিই তাকে খ্যাতি এনে দেয়। বিবিসি বাংলা বিভাগের দর্শকদের জরিপে এই গান বাংলা গানের ইতিহাসে তৃতীয় সেরা গানের মর্যাদা পেয়েছে।

স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি সপরিবারে লন্ডনে চলে যান। সেখানে ‘নতুন দিন’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। প্রায় ৩৫টি বই লিখেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই নিয়মিত কলাম লিখতেন ঢাকা ও কলকাতার দৈনিক পত্রিকায়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের এই মানুষটি যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন দেশে-বিদেশে সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে চলেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

তিনি প্রথা ভেঙে ভেঙেই সামনে এগিয়েছেন। সময়ের সূর্য সন্তান আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো দার্শনিকরা প্রথা মানলে অজানার নতুন দরজা-জানালা খোলা যায় না। দৃষ্টির সীমানা শেষের ওই পারে কী আছে তা তো কোনো ছকে থেকে দেখা যায় না। ওই ধরাবাঁধা ছক রেখে যে বাইরে তাকাতে পারে তাকেই বলে নবযাত্রার নাবিক।

আবদুল গাফফার চৌধুরী সেই নাবিক। যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বেড়ে উঠেছেন। তাই বলে কি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করবেন না? তিনি সব সময় দলটির সমালোচনায় মুখর থেকেছেন। নেতা, এমপি-মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বাদ যাননি তাঁর সমালোচনার তীর থেকে। কোথাও কোনো অসঙ্গতি দেখলেই তাঁর তীর্যক কলম সেদিকে আঘাত করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা মিথ্যাচার করেছিল, তার মোক্ষম উত্তর আমরা আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে শুনেছি। অভিজ্ঞতা ও তীর্যক দৃষ্টির কারণে তিনি আমাদের বারবার সঠিক ইতিহাস জানিয়ে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছেন।

ইতিহাসের সেই বইটি আজ থেকে আর পাতা উল্টাবে না। আমরা আর ইতিহাসের নয়া পাঠ পাবো না তাঁর কাছ থেকে। বিদায় কিংবদন্তি। বিদায় চলন্ত ইতিহাস। বিদায় বহুমুখী প্রতিভাধর প্রিয় আবদুল গাফফার চৌধুরী। আপনার এলাকার সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়া, মস্কো, রাশিয়া।

কারই/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর