ফেনী (ফুলগাজী-পরশুরাম) আর বন্যা যেন এখন একে অপরের পরিপূরক হয় দাঁড়িয়েছে। ফেনীর বন্যা নাকি বন্যার ফেনী? ফেনীর আমজনতার দৃষ্টিতে এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যাগুলোর মূল কারণ ‘উজান-ভাটি’ তত্ত্ব। উজানে ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়ায় পানিতে ডুবে ফেনী, আর ভাটিতে পর্যাপ্ত স্লুইস গেট না থাকায় সড়কে বাধা পেয়ে সেই পানি সরতে পারে না। বেশিরভাগ ফেনীর সাধারণ মানুষের ধারণা এখন এমনটাই।
বিষয়টি আংশিক সত্যি হলেও জলবায়ু পরিবর্তন এসব সমস্যার মূল কারণ। উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপকভাবে বনভূমি উজাড় করা এবং খনিজ সম্পদ আহরণের কারণে ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলে পলির পরিমাণ বাড়ছে। এতে শুধু ফেনী অঞ্চলের নদীগুলো নয়, পাশাপাশি হাওড়ের তলদেশের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। সঙ্গত কারণেই এসব নদী আর হাওড়ের জলধারণ ক্ষমতা ক্রমেই কমছে।
বিজ্ঞাপন
জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নিম্নোক্ত কারণগুলোকে বিশেষজ্ঞ ও এলাকার মানুষ ঘন ঘন বন্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
১. নদীর নাব্যতা সংকট
২. উজানের পানি
৩. বেড়িবাঁধ টেকসই না হওয়া
৪. স্লুইসগেট না থাকা
৫. বেড়িবাঁধ নদীর তীরবর্তী হওয়া।
৬. নদীর ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করার সময় স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে সমন্বয়হীনতা।

কদিন আগে টিভির খবরে সৌদি আরব কিংবা দুবাইয়ে প্রবল বর্ষণে বন্যার দৃশ্যে আমরা যারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি, তারাই কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে নিজের ঘরের পাশে কি হচ্ছে সে বিষয়ে অনেক সময়ই উদাসীন থেকেছি। ফেনী সংলগ্ন ভারতের এলাকাগুলো এমনিতেই বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। ওই এলাকাগুলোতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এমনিতেই একটা কথা প্রচলিত আছে- ভারতে অতিবৃষ্টি হলে ফেনীতে বন্যা হবে বারো ঘণ্টা পর। আর ফলশ্রুতিতে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম আবারও ডুবেছে। গতবারের মতো অত বেশি না হলেও বরাবরের চেয়ে বেশি।
বিজ্ঞাপন
গত কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ এবং ত্রিপুরা থেকে পাহাড়ি ঢলের উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ফেনীর পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শালধর ও বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের বাঘমারা এলাকায় দুটি এবং ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের দৌলতপুরে তিনটি, নিলক্ষী ও একরামনগরে দুটি বেড়িবাঁধ ভেঙে ১০ গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানি বন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার (১ জুলাই) সন্ধ্যায় মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে থাকে। স্থানীয়রা জানায়, এক পর্যায় বাঁধ উপচিয়ে ফুলগাজী বাজারে পানি প্রবেশ করে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের ফুলগাজী বাজার অংশ এক হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। সড়কের পাশে অনেকের দোকানে ঢলের পানি ঢুকে ব্যবসায়ীদের মালামাল নষ্ট হয়। সাময়িক ফেনী-পরশুরাম সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে কহুয়া নদীতে পড়ে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে এ দুই উপজেলায় গত মঙ্গলবারের (২ জুলাই) এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।

ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর দুই তীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে প্রতিবছরই ভাঙন দেখা দেয়। বন্যার কবলে পড়ে সর্বশান্ত হতে হয় ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার লক্ষাধিক মানুষকে। প্রতিবছর বন্যার কারণে হাজার হাজার হেক্টর আবাদি ফসল নষ্ট হয়। বন্যা থেকে রক্ষা পেতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেও সে বাঁধ তাদের জন্য আর্শিবাদের পরিবর্তে অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা খরচ করে বাঁধ মেরামত করেও বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে পারেনি স্থানীয়দের।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে দেখা দেয় ভাঙন। প্রতি বছর এই বাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলের মাঠসহ ভেসে যায় পুকুরের মাছও। অথচ ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলাকে বন্যা থেকে রক্ষায় ২০১১ সালে নির্মিত হয়েছে ১’শ ২২ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ। কিন্তু নির্মাণের পর থেকে আশানুরূপ কোন ফলাফল পায়নি এলাকার বাসিন্দারা।
তবে যা অত্যন্ত জরুরি তা হলো, এই সমস্যার স্থায়ী একটা সমাধান খুঁজে বের করা। ফেনীর যে অঞ্চলে একটি স্থলবন্দর অবস্থিত, যার মাধ্যমে ব্যবসার বড় সুযোগ রয়েছে। যে অঞ্চলের মানুষের রেমিট্যান্সের কন্ট্রিবিউশান অনেক বেশি, সে অঞ্চলের মানুষ যদি বছরে বার মাসের মধ্যে কয়েক মাসই পানিতে ডুবে থাকে, সেটা সামষ্টিকভাবে পুরো দেশের জন্যই অকল্যাণকর। ফেনীতে বন্যা ছিল, আছে, থাকবে, কিন্তু মুহুরী ও কহুয়া নদীর সংযোগ স্থলে একটি স্লুইসগেট স্থাপন ও টেকসই বেড়ি বাঁধ দিয়ে স্থায়ী সমাধান করে ‘বন্যার ফেনী’ থেকে তো ফেনীকে মুক্তি দিতেই হবে।
লেখক: সিইও, রিয়েল ইন্টেরিয়র
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি ওনার্স এসোসিয়েশন- বিডকোয়া
অনার্স ও মাস্টার্স (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
পিএইচডি গবেষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

