রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

হায়রে সর্প, বিষধর সর্প

মো. বোরহানুল আশেকীন
প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২৪, ১০:৩৪ এএম

শেয়ার করুন:

হায়রে সর্প, বিষধর সর্প

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক স্ক্রল করলেই এখন দেখা যাচ্ছে সাপ নিয়ে বিভিন্ন রকমের খবর। বিশেষ করে রাসেলস ভাইপার নিয়ে খবর ছড়িয়েছে ভিন্ন মাত্রায়। এতে কেউ আতঙ্কিত, বিচলিত আবার কেউবা কৌতুহলী।

রাসেলস ভাইপার, যেটি এদেশে চন্দ্রবোড়া নামে বহুল পরিচিত। এটি বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে ছিল অনেক আগ থেকেই। দেশে যে কয়টি বিষধর সাপের প্রজাতি আছে তার মধ্যে অন্যতম বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর চেয়েও বিষধর সাপ আছে দেশে।


বিজ্ঞাপন


১৯২৯ সালে ভারতীয় লেখক মি. ব্যানার্জীর লেখা বইতে এক হাজারের বেশি সাপ দংশনের রোগীর প্রতিবেদন আছে, যেখানে ২২ জন রোগী তৎকালীন বেঙ্গল তথা যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের।

২০১৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা থেকে একটি মৃত সাপের বাচ্চা নিয়ে সাপে কাটা রোগী আসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অজগর সাপের বাচ্চা মনে করে ধরতে গেলে ভুক্তভোগীকে দংশন করে সাপটি, পরে সাপটিকে রাসেলস ভাইপার হিসেবে শনাক্ত করেন বিশেষজ্ঞরা। এটিকেই বলা হয় দেশে রাসেলস ভাইপারে দংশনকৃত প্রথম রোগী।

ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা বলছে দেশের ২৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব আছে। বিশেষ করে পদ্মা নদী ও তার শাখা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে এর বিস্তার ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।

ভেনম রিসার্চ সেন্টার জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের গবেষণা থেকে দেখা যায়, দেশের ১১ জেলায় (নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম) এক সময় রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি থাকলেও ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত নতুন ৬টি জেলাসহ শুধুমাত্র ৯টি জেলায় (দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবানা, রাজবাড়ী, চুয়াডাঙ্গা ও পটুয়াখালী) রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল।


বিজ্ঞাপন


শুধুমাত্র নিশ্চিত তথ্য যেমন সংগ্রহ করা সাপ, দংশনকৃত রোগী ইত্যাদি থেকে ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকদের করা ২০২৩ সালের গবেষণাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগের বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ ছাড়া ৬টি জেলা; ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ, খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলা; চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষীপুর জেলা; বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর ছাড়া বাকি ৫টি জেলা নিয়ে সর্বমোট ২৩টি জেলায় রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি নথিভুক্ত করা হয়।

পরবর্তীতে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত আরও ৪টি জেলায় (যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর) এই সাপের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

রাসেলস ভাইপার সাপ কোন জেলায় কত জনকে দংশন করেছে বা এই সাপের কামড়ে কতজনের মৃত্যু হয়েছে সার্বিকভাবে কোন তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে। তবে রাজশাহী মেডিকেলের কাছে রয়েছে কিছু তথ্য, যেটি ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সেই তথ্য নবায়ন করা হচ্ছে।

রাজশাহী মেডেকেল কলেজের তথ্য বলছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের ১২ জুন পর্যন্ত রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার হয়েছেন ২৫৩ জন, আর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৬৬ জন, আর মৃত্যু হয়েছে ৬৯ জনের। এই সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, নাটোর ও চুয়াডাঙ্গার সাপে দংশনের রোগীরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দংশনের শিকার হয়েছেন ৫০ জন। আর ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১২৫ জন এই সাপের ছোবলের শিকার হয়েছেন।

আর ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত রাসেলস ভাইপারের ছোবলের শিকার হয়েছেন ১৬ জন, এর মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন।

গেলো বছর টক্সিকোলজি সোসাইিট অব বাংলাদেশ থেকে একটি গবেষণা করা হয়, যেখানে দেখা যায় বছরে সাড়ে সাত হাজার মানুষ সাপের দংশনে মারা যায়। যা এই সংখ্যা বিগত বছরের চেয়ে বেশি। তবে কোন প্রজাতির সাপের কারণে মৃত্যু হয় তা জানা যায়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী জানান, দেশে প্রায় ১০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এরমধ্যে ৩০ থেকে ৩২ প্রজাতির সাপ বিষধর। আবার এরমধ্যে ১৫-১৬ প্রজাতি হলো সামুদ্রিক। বাকি যে ১২ থেকে ১৫ প্রজাতির বিষধর সাপ আছে সেগুলোর সংস্পর্শে আসে মানুষ। তিনি বলছেন, ১০০টি সাপের কামড় হলে ১২ থেকে ১৫টি হবে বিষধর সাপের কামড়। বাকিগুলো বিষহীন সাপের কামড় হবে। তবে যে সাপই কামড় দিক না কেন অবশ্যই হাসপাতালে যেতে হবে দ্রুত সময়ে।

গবেষণা বলছে, একটি রাসেলস ভাইপার প্রতিদিন ৩০০ মিটার ভ্রমণ করতে পারে, আর বছরে করতে পারে ১০০ কিলোমিটার। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক এম  এ ফয়েজের ধারণা, ২০১৩ সাল থেকে এই সাপের যে প্রজননক্ষমতা ও বিস্তার এ কারণে পার্বত্য জেলা বাদে সব জেলায় রাসেলস ভাইপার ছড়িয়ে পড়েতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. রোবেদ আমিনের মত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব তথ্য প্রচারিত হচ্ছে রাসেলস ভাইপার নিয়ে তার বেশিরভাগই সত্য নয়। এছাড়া এসব করে সাপের প্রতি একধনের হিংসাত্মক মানসিকতা তৈরী হচ্ছে বলেও মত তার।

রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মৃত্যু কারণ বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সাপে দংশনের পর রোগীকে দ্রুত সময়ে হাসপাতালে আনা হয়নি, ফলে দেয়া যায়নি অ্যান্টি ভেনম। ফলে একাধিক অ্যান্টি ভেনম দেবার পরও বাঁচানো যায়নি তাদের। তাই চিকিৎকরা বলছেন সাপে কামড়ের পর অবশ্যই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিকটস্থ হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যেতে হবে।

এখন প্রশ্ন এবছর রাসেলস ভাইপার নিয়ে এত মাতামাতির কারণ কী? বলা যায়, সাপে কাটলেই ধরে নেয়া হচ্ছে, রাসেলস ভাইপারই কামড় দিয়েছে। আবার সাপে কাটার পর অনেকের হয়েছে মৃত্যু। কিন্তু কোন সাপের কামড়ে মৃত্যু হচ্ছে সেটিও নির্ণয় করা হয়নি। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমেও রাসেলস ভাইপারের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।

তবে ভেনম রিসার্চ সেন্টার বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; সাপের আবাসস্থল ধ্বংস; অবকাঠামো উন্নয়ন; বন্যার পানি ও কচুরীপানার সাথে নদীর পানির বিস্তার; রাসেলস ভাইপারের প্রজননক্ষমতা; গুইসাপ, বেজি, পেঁচা, চিল, বাজপাখির মত শিকারী পাখি কমে যাওয়ার কারণে রাসেলস ভাইপারের বিস্তার হচ্ছে।

তবে আতঙ্কিত বা বিচলিত না হয়ে সতকর্তার উপর জোর দিচ্ছেন গবেষকসহ চিকিৎসকরা।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর