রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

খুঁটির জোরে ছাগল নাচে

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২৪, ০৯:৩৭ পিএম

শেয়ার করুন:

সড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যাবে কি

পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক অপরাধ সংগঠনে সন্ত্রাসী বাহিনীর জায়গা এখন ‘দখল’ করেছে কথিত ‘কিশোর গ্যাং’ নামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। গ্রামে কিংবা শহরের ভয়ানক আতঙ্কের নাম ‘কিশোর গ্যাং’। যদিও এসব বাহিনীর সদস্যদের বেশিরভাগই ১৫ থেকে ১৮ বছরের বেশি বয়সী। ২০১২ সাল থেকে ‘কিশোর গ্যাং’ নামক একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও ২০১৭ সালে উত্তরায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির খুনের পর এদের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে মাঠে নামে। ২০১২ সালে যেখানে কিশোর অপরাধে ৪৮৪টি মামলায় ৭৫১ জন আসামি ছিল, সেখানে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসেই ৮২১টি মামলায় এক হাজার ১৯১ জন শিশু-কিশোর আসামি হয়। ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ঢাকা ও এর আশপাশে ১২টি এবং সারা দেশে কমপক্ষে ৩৫টি কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বর্তমানে রাজধানীতে এ ধরনের ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা কমপক্ষে ৭৮ এবং সদস্য সংখ্যা দুই হাজারের বেশি।

সমাজ চিন্তকরা সামাজিক অবক্ষয়, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাকেই এই সামাজিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে গণ্য করছেন। কালের আবর্তনে আমাদের সামাজিক অবক্ষয় দৃশ্যমান। এক সময় আমাদের সমাজে মূল্যবোধের চর্চার ঐতিহ্য ছিল। সমাজে ‘মুরব্বি’ সংস্কৃতির চর্চা ছিল। পাড়ার বয়স্কদের ছোটরা সম্মান করত। দূর থেকেই সালাম দিত, হাতে সিগারেট থাকলে ফেলে দিত। অন্যায় করতে দেখলে বড়রাও ছোটদের শাসন করত। ছোটরা বেয়াদবি করলে বড়রা এগিয়ে এসে বিচার সালিশ বসাত। সেই ঐতিহ্য আজ ভেঙে পড়ছে। মুরব্বিরা ভীত, কিশোর-তরুণরা বেপরোয়া। তারা আজ কিশোর গ্যাং নামক সন্ত্রাসী বাহিনী। সামাজিক সেই বন্ধন ও শৃঙ্খলায় ধস নেমেছে। বাবা-মায়েরা পেশা ও ব্যবসায় টাকা রোজগারে ব্যস্ত। সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন তারা। সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদি দেখার সময় তাদের নেই? তাছাড়া ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা, দ্বন্দ্ব-কলহ এবং পরিবারে ভাঙনের কারণে সন্তানরা সহজেই আজ বিপথগামী হয়ে পড়ছে। ফলে ঘরে ঘরে আজ অশান্তির আগুন জ্বলছে। বস্তি থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সব ঘরের ছেলে-মেয়েরাই এভাবে বিপথগামী হয়ে কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিদিনই দেশজুড়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করা— দেশের যেকোনো এলাকায় এখন এ ধরনের অপরাধ ঘটলে ‘কিশোর গ্যাং’-এর নাম উঠে আসছে। অথচ এক সময় বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় নাম আসত কোনো না কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর। আর এখন রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের নাম। শহর থেকে গ্রামেও বিস্তৃত হয়েছে কিশোর অপরাধীদের নেটওয়ার্ক। খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান, মাদক সেবনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। আধিপত্য নিয়ে বিরোধে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে তারা। ঘটছে খুনের ঘটনা। যা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রে প্রতিনিয়তই জানা যায়।

‘বড় ভাই সালাম দিছে, সামনে পার্টি... কিংবা কাকা সালামি কই?’ ঈদ, নববর্ষ, থার্টিফাস্ট নাইটের নামে এভাবেই নীরবে চাঁদাবাজি করছে এই উঠতি বয়সী ছেলেরা। এমন কোনো অপরাধ নেই কিশোর গ্যাং করছে না। আসলে এই কিশোর গ্যাংয়ের খুঁটির জোর কোথায়? এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে— আসলে এই বড় ভাই কারা? তারা কি রাজনৈতিক নেতা, নাকি বড় কোনো আমলা, নাকি সন্ত্রাসী গডফাদার। কাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এই কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি। তাদের এসব কর্মকাণ্ড সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

রাজধানীর বাইরে সাভারে প্রায় ১৫টি, টঙ্গীতে ৩০টি এবং নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোকে অপরাধের অভয়ারণ্য বানিয়ে রেখেছে। আর চট্টগ্রাম নগরে ৪৭ জন ‘বড় ভাই’ এর অধীনে প্রায় ৩১টি গ্রুপে ৬০০ সদস্য ৪৫টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। সাভারে ভাইয়ের কাছ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা, বরগুনায় নয়ন বন্ডের দ্বারা রিফাত খুন, বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড আর সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রনেতাদের দ্বারা স্বামীকে আটকে গৃহবধূকে গণধর্ষণ ইত্যাদি সবই কিশোর গ্যাংয়ের বিষফল। এদের অত্যাচার নির্যাতনে সমাজ বিষিয়ে উঠেছে। সমাজের নিরীহ মানুষ যারা, বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই তাদের আতঙ্কই বেশি। তারা তাদের সহায়-সম্পদ ও উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটায়; কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করে অথবা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে কখন কোন বখাটে বিরক্ত করে বা স্কুলে যাওয়া ছেলেটিকে তাদের গ্যাংয়ের দলে ভিড়িয়ে ফেলে। এ ছাড়া এসব গ্যাংয়ের উৎপাতে পাড়ায় পাড়ায় মারামারি কাটাকাটি তো লেগেই আছে। শহুরে জীবনের পাড়ায় পাড়ায় কিশোর-তরুণরা প্রথমে ছোট ছোট গ্রুপ করে ‘স্টার বন্ড’, ‘সাইজ কইরা দে’, ‘আমিই বস’ ইত্যাদি রোমাঞ্চকর গ্রুপের নামে আড্ডারাজি শুরু করে। ধীরে ধীরে শুরু হয় ছোট ছোট দলগত অপরাধকর্ম ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার। অন্য দল বা অন্য এলাকার কিশোরদের ওপর প্রভাবশালী হয়ে উঠার এক রোমাঞ্চকর স্বাদ তারা পেয়ে যায় কাউকে মারধর করে বা অপমান করে। ভিকটিমরাও তখন প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে ঘটে যায় খুনের ঘটনা। জড়িত হয়ে পড়ে স্থানীয় নেতারাও। তারা ‘বড় ভাই’ হিসেবে আগলে রাখেন গ্যাংগুলোকে। বিনিময়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকেন এসব গ্যাংকে। এভাবে একটি কিশোর গ্যাং জন্ম নিয়ে দাপটের সাথে এলাকায় বিস্তার করে ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’।

গত ২২ মার্চ দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে ‘৫ কাউন্সিলরসহ ৬৪ বড় ভাইয়ের প্রশ্রয়ে চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে পুলিশের তথ্য দিয়ে বলা হয়, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন কতিপয় ‘বড় ভাই’।


বিজ্ঞাপন


এই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বর্তমানে তরুণদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। হিরোইজম বা বাহাদুরি, কাঁচা টাকা-পয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিক চর্চার নামে সস্তা ছেলে-মেয়েদের অবাধে মেলামেশার তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত এ সমস্ত গ্যাং এবং তাদের সদস্যসংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে টিকটক, লাইকি ইত্যাদি নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে তরুণরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। ফলে সমাজকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো খুবলে খেয়ে ফেলছে এই অশুভ চর্চা। উঠতি বয়সের, স্কুল-কলেজগামী কিশোরদের একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ওই দিকেই ঝুঁকছে। ফলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুড়ঙ্গের অপরপ্রান্তে জমা হচ্ছে নিকষ কালো অন্ধকার। যারা এই জাতিকে আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে তারা যদি এই আগ্রাসী কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির চর্চা করে বেড়ে ওঠে তবে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। সুতরাং আজকের কিশোর গ্যাং কালচার দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য এক মারাÍক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গত এপ্রিল মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কথিত কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এখন সারা দেশে ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম নয়, জেলা শহরগুলোতেও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর দুটি ঘটনার পর কথিত কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এসেছিল ক্ষমতাসীন স্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা। কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তথা নেপথ্যের শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

যারা গ্যাং তৈরি করছে এবং নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে অপরাধ করাচ্ছে, তারা আইনের মুখোমুখি হওয়া থেকে দূরেই থাকছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে পেছনের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। তবে কিশোর অপরাধের মাত্রা যে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ভয়ংকর রূপ নিয়েছে ‘কিশোর গ্যাং’ নামধারী সন্ত্রাসী বাহিনী। বিভিন্ন এলাকায় মানুষের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে গ্যাংগুলো। রাজনৈতিক শক্তি ও পরিচয় ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ব্যতীত কিশোর গ্যাং সমস্যার সমাধান হবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর