রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আমার মা আমার বেহেশত

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৪, ০৭:৩৪ পিএম

শেয়ার করুন:

আহসান হাবিব
আহসান হাবিব

আমার একলা চলার পথে, মন খারাপের রাতে, তুমিই সঙ্গী মা। ‘মা’ এ শব্দটির চেয়ে আপন শব্দ আর পৃথিবীতে নেই। জন্মের পর থেকে মানুষের মুখে এ শব্দই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়। আমরা ভুলে যাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিটি হচ্ছেন মা। আর মায়ের ভালোবাসা কখনোই শেষ হওয়ার নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে তার মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সবচেয়ে বড় বিষয়, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।

ব্রিটিশ লেখিকা জে কে রাউলিংয়ের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে ‘মায়ের ভালোবাসা এতোটাই শক্তিশালী যে এটি সবসময় নিজের চিহ্ন রেখে যায়। এত বেশি গভীর আর শক্তিধর সেই ভালোবাসা, যা সারাজীবন সুরক্ষা কবজের মতো আমাদের ঘিরে থাকে।’ নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছেন, ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।’ ক্যালেন্ডারে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার, ধার্য করা হয় পৃথিবীর প্রত্যেক মায়েদের জন্য। তা হচ্ছে ‘মা দিবস’। মা, এই একটি শব্দেই থাকে ভালোবাসার ভাণ্ডার। মা ভালোবাসি তোমায়, বলতে পারিনি কখনো। আজ বললাম। মাগো তোমার কোলে মাথা রাখলে ভুলে যাই সব দুঃখ, কষ্ট। মায়ের এই আÍত্যাগ এবং ভালোবাসার জন্য প্রতিটি সন্তানের উচিত মাকে আগলে রাখা। মাকে ভালোবাসা জানানোর জন্য আলাদা দিনের প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণই মায়ের ভালোবাসা কাজ করে। দুনিয়ায় সবকিছুই বদলাতে পারে কিন্তু মায়ের ভালোবাসা কখনো বদলায় না।


বিজ্ঞাপন


দিনটি কীভাবে এলো? কেন পালন করা হয় এ মা দিবস? ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে এক শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। তিনি কাজ করতেন নারী অধিকার নিয়ে। ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন তিনি। অ্যানের কন্যা সন্তানের নাম আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস। একদিন ছোট্ট মেয়ের সামনেই অ্যান হাতজোড় করে বলেছিলেন, ‘আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ তারা প্রতিদিন মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। এটি তাদের অধিকার।’ ১৯০৫ সালে অ্যান মারা যান। তার মৃত্যুর পর মেয়ে আনা মায়ের স্বপ্ন পূরণে কাজ শুরু করেন। সব মাকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি দিবস প্রচলনের লক্ষ্যে সচেষ্ট হন তিনি। বিশ্বের প্রথম মা দিবসের প্রচলন হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। দিনটি সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। দিবসটির প্রবক্তা আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস। যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে।

মা ছাড়া শৈশব: বাড়ির পাশের গ্রামের মাঠে প্রতিদিন সজীব (ছদ্মনাম) একটি ছেলে খেলতে যায়। ছেলেটি খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ একটা কথা তার কানে আসায় সে থেমে গেল। মাঠের অপর এক প্রান্তে দুটো শিশু খেলছিল। ছেলে দুটির একটির নাম আকাশ এবং অন্যটির নাম বাদল (ছদ্মনাম)। হঠাৎ একজন আরেকজনকে বলল, ‘তোর নতুন মা চলে গেছে।’ বিষয়টা নিয়ে ওই শিশুদের কিছু না বলে সজীব ছেলেটি পাশের বন্ধুদের সহায়তা নিল।

হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুরা জানালো যে, আকাশ নামে শিশুটির বাবা বেশ কিছুদিন আগে তার মাকে ছেড়ে দিয়েছে। শিশুটি নানা আইনি জটিলতায় তার মার কাছে যেতে পারছে না। শিশুটির বাবা নতুন বিয়ে করেছে। গ্রামে মাঠ না থাকায় পাশের গ্রামে খেলতে যায় সজীব। আর মাঠে খেলতে গেলেই আকাশ নামের ছেলেটির সঙ্গে দেখা হয়। ব্যাট, স্ট্যাম্প মাঠে নিয়ে যাওয়াসহ খেলার সময় বল মাঠের বাইরে গেলে তাও এনে দেয় এতিম ছেলেটি। বিনিময়ে মা না থাকা ছেলেটি খেলা শুরু হওয়ার আগে এবং শেষ হওয়ার পরে ৫-৭ মিনিট বল, ব্যাট নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলে।

ওর যে বয়স তাতে মা বাবার আদর-স্নেহে বড় হওয়ার কথা। ভুল করলে মা বাবার শাসনে নিজেকে শুধরে নেবে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এই বয়সেই তারা মা বাবা থাকা সত্ত্বেও সে আদর-স্নেহে থেকে বঞ্চিত! এভাবেই ছেলেটি আস্তে আস্তে শৈশব থেকে কৈশোরে পরিণত হয়। এখন যদি বলা হয়, ওরা এই বয়সে আদর-স্নেহে থেকে বঞ্চিত হবে কেন? কেন মা-বাবা থাকা সত্ত্বেও মা বাবাকে ডাকতে পারবে না? কেন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে রাত কাটাতে পারবে না? এদের ভুল কোথায়? কি দোষ করেছে এরা? পৃথিবীতে এদের মতো হাজারো শিশু রয়েছে যারা মা বাবা থাকা সত্ত্বেও তাদের আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত! কেউ কেউ অনাথ না হয়েও দিনযাপন করছে অনাথ আশ্রমে। কেউ কেউ জানেই না তাদের মা বাবা বেঁচে আছে কি নেই।


বিজ্ঞাপন


মা ছাড়া জীবন অন্ধকার, অর্থহীন। বর্তমান যুগে মায়ের প্রতি ভালোবাসাটা মুহূর্তের ভালোবাসায় যেন সীমাবদ্ধ। বছরের একটি দিন দিবস হিসাবে বেছে নিয়ে, একটা সেলফি তুলে ছবি পোস্ট করলেই সন্তানের দায়িত্ব পালন হয় না। আমরা বড় বড় জ্ঞানের বাণী শুনিয়ে থাকি। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেশি দূর যেতে হবে না। আমার বা আপনার আশপাশে খবর নিলেই দেখতে পাবেন, সন্তান প্রতিষ্ঠিত করতে মায়ের কষ্টের শেষ নেই। সন্তান হয়তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সরকারি বড় কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা, বড় ব্যবসায়ী কিংবা ইউরোপ-আমেরিকা প্রবাসী। অনেক সন্তানের অর্থসম্পদের অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ না করে নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আর মায়েরা অসহায়ের মতো ঘরে বা কোনো বৃদ্ধাশ্রমে অবহেলায়, অযত্নে দিন কাটান। নেই সুন্দর কাপড়চোপড়, ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া, চিকিৎসা, ঔষধ। অবহেলায় অযতেœ বুকের ভেতর পাথর চেপে চোখের জল মোছেন প্রতিনিয়ত।

মা নামের এই ভালোবাসাগুলো বুঝি সারাদিন বৃদ্ধাশ্রমের এই জানালা দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে এই বুঝি তার কেউ এলো, তাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘মা নিয়ে যেতে এসেছি তোমায়, চলো তুমি আমার সঙ্গে আমার ঠিকানায়।’ ততক্ষণে হারিয়ে যাই এক ভাবনার জগতে। সন্তানরা হয় কেউ বড় ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু মাকে রেখে গেছেন এই কুঠুরিতে। মাকে দেখার সময় তাদের হয় না। যে মা অক্লান্ত পরিশ্রমে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে হাজারো ব্যস্ততায় আগলে রেখেছেন সন্তানদের, সেই সন্তানদেরই এখন সময় নেই মাকে যত্ন করার কিংবা হাসিমুখে একটু কথা বলার। বরং মাকে ফেলে গেছেন রাস্তায়। আমরা পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখতে পাই ছেলে মা-বাবার কাছ থেকে জায়গা-জমি লেখে নিয়ে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু মা তো সেটা বিশ্বাস করতে চায় না, বরাবর পরিবারের গল্পেই মেতে থাকেন তিনি। 

গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা: এক বৃদ্ধা মা তার ছেলে, ছেলের বউ ও ছয় বছরের এক নাতির সাথে বসবাস করত। বৃদ্ধা মা খুবই দুর্বল ছিলেন। তিনি ঠিকভাবে হাঁটতে পারতেন না, চোখে কম দেখতেন, তার হাত কাঁপতো, ঠিকমতো কিছু ধরতে পারতেন না। পরিবারের সকলে যখন একসাথে খেতে বসতেন তখন প্রায়ই কোনো না কোনো অঘটন ঘটে যেত। কোনোদিন হাত কাঁপতে কাঁপতে দুধের গ্লাস ফেলে টেবিল নষ্ট করতেন, আবার কোনোদিন ফ্লোরে তরকারি ফেলে দিতেন। প্রতিদিন খাওয়ার সময় এরকম ঝামেলা হওয়ায় ছেলে তার মায়ের জন্য আলাদা টেবিল বানিয়ে ঘরের কোণায় সেট করে দিল। বৃদ্ধা মা সেখানে একা বসে খেতেন আর একা একা চোখের পানি ফেলতেন। ছোট নাতিটি এসব নীরবে দেখছিল। একদিন বৃদ্ধা মা কাচের প্লেট ভেঙে ফেললেন। এজন্য ছেলেটি তার মাকে একটি কাঠের প্লেট বানিয়ে দিল।

একদিন বিকালে বৃদ্ধার ছেলেটি দেখল তার বাচ্চা ছেলেটি কাঠের টুকরা দিয়ে কি  যেন বানাতে চাচ্ছে। বাবা তার ছেলের কাছে জানতে চাইল, বাবা কি করছো? তখন শিশুটি বলল, আমি একটি টেবিল ও কাঠের প্লেট বানাচ্ছি। যখন আম্মু বুড়ো হবে তখন কিসে খাবে! তাই আগে থেকেই বানিয়ে রাখছি। এ কথা শুনে ছেলে তার ভুল বুঝতে পারল যে, বৃদ্ধ হলে তার সন্তানও তার সাথে এমন আচরণ করবে। তাই সে তার স্ত্রীকে বলল, এখন থেকে আমরা দুজন প্রতিদিন মাকে খাওয়ায়ে তারপর খাব। প্রতিদিনের মতো খাবারের সময় হলো, ছেলে মাকে আনতে মায়ের বিছানায় গেল। কিন্তু গিয়ে দেখল, তার গর্ভধারিণী মা ইহকাল পাড়ি দিয়ে পরপারে চলে গেছেন (ইন্নালিল্লাহ)। তাদের আর ভাগ্যে হলো না একত্রে বসার।

আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের বাবা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যান, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাপনের পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। কোনো পিতা-মাতার ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হতে হবে। প্রত্যেক বাবা-মার জন্য তৈরি করতে হবে একটি নিরাপদ ও সুন্দর আশ্রয়। প্রতিটি বাড়ি যেন হয় উন্নত মানের বৃদ্ধাশ্রম। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, বৃদ্ধাশ্রম থেকে বৃদ্ধ মা-বাবার চিঠি তার ব্যস্ত সন্তানদের কাছে। হাজারো আবেগ অভিমানের চিঠি পড়লে চোখে পানি এসে যায়। তারপরও সন্তানদের একটু সময় হয় না সেই চিঠিগুলোর উত্তর লেখার। হয়তো চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় থেকেই অনেক বৃদ্ধ মা পৃথিবীর হিসাব-নিকাশের খাতাটা বন্ধ করে পরপারে পাড়ি জমান। হয়তো এক সময়ে সন্তান ভুল বুঝতে পারবে কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকবে না। বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবা শিশুদের মতো হয়ে যান। শিশুসুলভ আচরণ করেন। তারা যেমন করে আমাদেরকে শৈশব থেকে শুরু করে শত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে মানুষ করেছেন। আমাদেরও কর্তব্য সেই মানুষগুলোকে জীবনের শেষ সময়টুকুতে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে না রেখে নিজের কাছে রেখে সেবা করা। মনে রাখা সমীচীন যে, আমরাও একদিন বৃদ্ধ হব। আমরা যদি আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি, আমাদের সন্তানরাও হয়তো একদিন আমাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। পৃথিবীর সকল মায়েদের প্রতি আমার সালাম, শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা, শুভকামনা। পরিশেষে শুধু এতটুকুই বলব, মা আমার মা, তোমায় অনেক ভালোবাসি মা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর