দেশের সত্যিকার এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উদ্যোক্তা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বে সম্ভবত একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা উদ্যোক্তা উন্নয়নের ইস্যুটিকে উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। একটি দেশের দ্রুত ও বড় ডেভেলপমেন্ট নির্ভর করে সে দেশের নতুন নতুন উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তাদের উপর।
আমাদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে, উদ্যোগ মানে শুধু ব্যবসা উদ্যোগকে আমরা বুঝি। কিন্তু আসলে উদ্যোগ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সেটা হতে পারে সরকারি উদ্যোগ, বেসরকারি উদ্যোগ, সামাজিক উদ্যোগ, পারিবারিক উদ্যোগ, ব্যবসা উদ্যোগ। তবে আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় ব্যবসা উদ্যোগ।
বিজ্ঞাপন
উদ্যোক্তা বলতে আমরা কাদের বুঝি? উদ্যোক্তা বলতে সাধারণভাবে আমরা এমন একজনকে বুঝি, যিনি উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করে নতুন কিছু সৃষ্টি করেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিতে পারেন, যিনি পুরোনোর মাঝে নতুনত্ব খুঁজে বের করার জন্য নিরন্তর সচেষ্ট থাকেন, যার মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান থাকে, এছাড়াও বিপণনব্যবস্থা সম্পর্কেও যার প্রাথমিক ধারণা থাকে।
একজন উদ্যোক্তা অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এবং এ প্রভাব কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক কল্যাণকে প্রভাবিত করে। উদ্যোক্তাকে বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যের বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটি উন্নয়নের জন্য একটি প্যানাসিয়া।
বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বিশেষ পর্যায়। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি যখন ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ কর্মক্ষম থাকে, সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। একটি জাতির জীবনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই আসে। কারো মতে, হাজার বছরে একবার এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে, তারাই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে উপনীত হতে পেরেছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল পেতে হলে জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। আর জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার অন্যতম উপায় হলো বাংলাদেশের যুবকদের মাঝে উদ্যোক্তা চেতনা জাগ্রত করা এবং উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে উদ্যোক্তা তৈরি করা।
তরুণ উদ্যোক্তা তৈরির জন্য করণীয়:
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে তরুণরা উদ্যোক্তা হওয়ার পথে যেসকল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, সেগুলো নিরসনের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
১. উদ্যোক্তা তথ্য সেবা প্রতিষ্ঠান চালুকরণ:
বাংলাদেশে তরুণ ও কর্মক্ষম বেকার হারকে উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে তরুণদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প কিছুই নেই। সেজন্যে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের উচিত চলমান সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তরুণদেরকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে এবং তা সহজসাধ্য করার নিমিত্তে সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোক্তাদের জন্য তথ্য সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। যার মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় সকল তথ্য নির্ভূল ও বিশ্বস্থ মাধ্যম থেকে সহজেই গ্রহণ করতে পারবেন।
২. ‘উদ্যোক্তা ব্যাংক’ চালু করা:
বাংলাদেশে কর্মক্ষম, প্রবাসী ও ব্যবসায়ী মানুষদেরকে ব্যাংক ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক চালু রয়েছে (যেমন: ‘কর্মসংস্থান ব্যাংক’, ‘সমবায় ব্যাংক’, ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক’ ইত্যাদি)। কিন্তু বাংলাদেশে আজ অবধি উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্যে কোনো ব্যাংক স্থাপিত হয়নি। তাই উদ্যোক্তাদের, বিশেষত তরুণ উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্যে ‘উদ্যোক্তা ব্যাংক’ চালু করা জরুরি। যার মাধ্যমে কোনো ধরনের জটিলতা ও শর্তারোপ ছাড়াই বাংলাদেশি নবীন উদ্যোক্তারা স্বল্পসুদে এবং সম্ভব হলে বিনা সুদে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন। ফলে নতুন উদ্যোক্তারা আগের তুলনায় অনেক বেশি ব্যাংক ঋণ সুবিধা নিতে পারবেন এবং সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেরা সাবলম্বী হবেন এবং পাশাপাশি অন্যদের জন্যেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন।
৩. ‘উদ্যোক্তা আইন’ প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন:
বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্যে ‘উদ্যোক্তা আইন’ প্রনয়ণ করা এখন সময়ের দাবি। কেননা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তা প্রসারে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলেও আজ অবদি এর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। তাই উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার সম্মুন্নত রাখতে আইন প্রনয়ণ করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। বিশেষ করে, পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও জটিলতা দূরীকরণের জন্য উদ্যোক্তা-নির্ভর আইনের প্রয়োজন। যার মাধ্যমে চলমান সমস্যাগুলো অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব হবে।
৪. লাইসেন্স ও ভ্যাট-ট্যাক্স সহজিকরণ:
বাংলাদেশে উদ্যোক্তা তৈরি ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য তাদের ট্রেড লাইসেন্স ও কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনলাইন, দালালমুক্ত ও স্বল্প সময়ের মধ্যে করার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও উদ্যোগ শুরু করার প্রথম দুই-তিন বছর ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ ও পরবর্তীতে ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদান পক্রিয়া সহজ করতে হবে।
৫. নারী উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিকরণ:
বাংলাদেশে প্রচলিত উপার্জনমূলক ব্যবস্থায় নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেকাংশেই পিছিয়ে আছে। এটি তাদের উদ্যোক্তা হবার ক্ষেত্রেও সমানভাবে বিবেচনা করা হয়। এজন্য নীতি-নির্ধারক পর্যায় থেকে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্যে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যার মাধ্যমে নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন। তাছাড়াও সফল ও অভিজ্ঞ নারী উদ্যোক্তারা নতুন নারী উদ্যোক্তাদের মেনটরিং ও সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন।
৬. ‘মেনটরিং কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠাকরণ:
বাংলাদেশের তরুণদেরকে উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী করতে এবং তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করার নিমিত্তে কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে ‘মেনটরিং কাউন্সিল’ গঠনে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারেন। এতে দেশের সর্বত্র উদ্যোক্তাকে পেশা হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভবপর হবে এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রক্রিয়া সহজতর হবে।
৭. উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ:
উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এটা সত্যি যে, কিছু কিছু ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান আছে যারা উদ্যোক্তা উন্নয়নের নামে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সত্যিকারার্থে, স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে কিছু উপকার হলেও কখনই সত্যিকার উদ্যোক্তা উন্নয়ন সম্ভব নয়। একজন উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। সেই জন্য অনার্স- মাস্টার্স লেভেলে উদ্যোক্তা উন্নয়নকে বিষয় হিসেবে সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের প্রশিক্ষণগুলোও দীর্ঘ মেয়াদি হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে বড় সুযোগ হতে পারে বর্তমান এই তরুণ প্রজন্ম। কেননা, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও পরিসংখ্যান বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ জনগণ বয়সের মাপকাঠিতে তরুণ এবং কর্মক্ষম। যেটির কাছাকাছি অবস্থায় পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশও নেই। সুতরাং, সার্বিক দিক বিবেচনা করে বলা যায়, এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রাসমূহ পূরণের ক্ষেত্রে সর্ব ক্ষেত্রেই এই তরুণ প্রজন্মকেই কাজে লাগাতে হবে, তরুণদেরকেই ক্ষমতায়িত করতে হবে এবং উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। তবেই আশা করা যায়, বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে সর্বাধিক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবে।
লেখক: সিইও, রিয়েল ইন্টেরিয়র
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি ওনার্স এসোসিয়েশন- বিডকোয়া
অনার্স ও মাস্টার্স (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), পিএইচডি গবেষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

