মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

কিশোর গ্যাং: সংঘবদ্ধ অপরাধ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

বাকহীন ও শ্রবণহীন ব্যক্তির অধিকার এবং ইশারা ভাষার প্রসার

সাম্প্রতিক দেশের অন্যতম বহুল আলোচিত বিষয় কিশোর অপরাধ। দেশের কিশোরেরা দলবদ্ধ হয়ে অপরাধ করছে। কিশোরদের এরূপ দলবদ্ধতা ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। বর্তমানে দেশে কিশোর গ্যাং এর অপতৎপরতা ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। প্রতিদিন সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে উঠে প্রকাশ হচ্ছে ‘কিশোর অপরাধ’ বা ‘কিশোর গ্যাং’ বিষয়ক বিরূপ সংবাদ চিত্র। এতে জনমনে ভ্রান্তি ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। ‘কিশোর গ্যাং’ এর বিষয়ে পাড়া-মহল্লা, মিটিং, টকশো ও সুধী সমাবেশে আলোচনায় মুখরিত। এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায়। মহান জাতীয় সংসদেও এ প্রসঙ্গে একাধিক বার আলোচনা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ‘কিশোর গ্যাং’ বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারগণের প্রতি আহ্বান জানান। অতি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ প্রসঙ্গে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।


বিজ্ঞাপন


গত ১০ এপ্রিল চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের কবল হতে নিজ সন্তানকে বাঁচাতে হামলার শিকার হন একজন চিকিৎসক এবং তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রাম মহানগর ও ঢাকা মহানগরীতে বিরাজমান কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম্য বিষয়ে জাতীয় পত্রিকায় দফায় দফায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চট্টগ্রামে ৫ কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাইয়ের’ প্রশ্রয়ে  সক্রিয় কিশোর গ্যাং। প্রতিবেদনে উল্লেখ ও পুলিশের ভাষ্য মতে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে কিশোর গ্যাং এর পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ৫ নির্বাচিত কাউন্সিলর ও ৬৪ ‘বড় ভাই’। চট্টগ্রাম নগরীতে সক্রিয় অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং, যারা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে তারা। প্রতি দলে আছে ৫-১৫ জন সদস্য। যারা নিন্ম ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য এবং নামে কিশোর গ্যাং হলেও তারা ২০-৩২ বয়সী তরুণ।

পুলিশের তথ্য মতে, গত ছয় বছরে ৫৪৮ অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত, যার মধ্যে খুনের মামলা ৩৪টি। ‘কিশোর গ্যাং’ তৎপরতা ঢাকা মহানগরীতেও প্রকট। ঢাকা শহরে ২১ কাউন্সিলর কিশোর গ্যাংদের প্রশ্রয় প্রদান করছে এবং প্রায় ৬৭টি কিশোর গ্যাং এর অস্তিত্ব আছে। পুলিশ-র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭ সাল হতে এ পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৩৩১ কিশোর গ্যাং সদস্য বিবিধ অপরাধে গ্রেফতার হয়েছে।

3

সর্বযুগে অপরাধের অস্তিত্ব বিরাজমান ছিল। ‘অপরাধ’ কি ? এবং ‘কিশোর অপরাধ’ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকা প্রয়োজন। ‘অপরাধ’ হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ। প্রচলিত আইনের সুস্পষ্ট বরখেলাপ। যার ফলে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও সংহতি বিনষ্ট হয় এবং এক্ষেত্রে শাস্তির নির্ধারিত বিধান আছে। অপরদিকে ‘কিশোর অপরাধ’ হচ্ছে অপরিণত বয়সে ছেলে-মেয়েদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ। যা দেশের প্রচলিত আইন-শৃঙ্খলা, বিধি-বিধান ও রীতি-নীতি পরিপন্থী। তবে কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে নির্ধারিত শাস্তির পাশাপাশি সংশোধনের ব্যবস্থা আছে। আমাদের কিশোর সমাজ ক্রমেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এনিয়ে সমাজের সর্বস্তরে উৎকন্ঠা বিরাজ করছে।


বিজ্ঞাপন


সর্বমহলের জিজ্ঞাসা: কিশোর-কিশোরীরা সমাজের রীতি-নীতি, আদর্শ, প্রথা, ধর্মীয় মূল্যবোধ পরিপন্থী কর্মে কেন লিপ্ত হচ্ছে? অ-প্রাপ্ত বয়সী ছেলে-মেয়েদের বিরূপ আচরণসমূহ সমজ প্রত্যাশিত নয়। যা বিচ্যুত আচরণ হিসেবে বিবেচিত। ভয়ে বিষয় বিচ্যুত আচরণকারীগণই ক্রমান্নয়ে রাষ্ট্র বিরোধী ভয়ানক অপরাধে লিপ্ত হয়।

বর্তমান সময়ে সামাজিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ‘কিশোর গ্যাং’ তৎপরতা উদ্বেগজনক। সমাজের আদর্শচ্যুত কিশোরগণ দলবদ্ধ হয়ে অপরাধ করছে। তারা ‘কিশোর গ্যাং’ নামে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপর। গ্যাং কিংবা সংঘবদ্ধ হয়ে খুনোখুনি, জায়গা দখল, অপহরণ, মারামারি, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, ভাড়াটে খাটা, উত্ত্যক্তসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে কিশোরেরা। কিশোর অপরাধ সংশ্লিষ্ট প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘বড় ভাইয়া’গণই শিশু-কিশোর কর্তৃক সংগঠিত সকল অপরাধের নিয়ন্ত্রক। বা মাস্টার মাইন্ড। ‘বড়ভাইয়া’গণ সমাজের পেশাদার অপরাধী, মাস্তান কিংবা মুখোশধারী কাউন্সিলর কিংবা জনপ্রতিনিধি। ছদ্দবেশী ‘বড়ভাইয়া’গণ অবুঝ কিশোর দ্বারা সংঘঠিত অপরাধের মূল নায়ক ও মাস্টার মাইন্ডার। অন্তরালে গডফাদাররাই কিশোরদের প্রলুব্ধ করে এবং অপরাধে জড়িত করছে। কিশোরদের এ মর্মে আশ্বস্থ করা হচ্ছে যে, কিশোর বয়সের অপরাধেই শাস্তিযোগ্য নয়, বরং সহজ জামিনযোগ্য। ‘কিশোর গ্যাং’ আজ প্রভাবশালীদের ক্ষমতা, দাপট, দখলদারিত্ব, আধিপত্য বিস্তার ও অবৈধ উপার্যনের মাধ্যম। আদর্শচ্যুত কিশোরেরা আজ মোহগ্রস্থ। স্বীয় কৃত অপরাধের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে মোটেও ভাবে না। কিশোরেরা স্বল্প লোভের শিকার এবং ‘বড়ভাইয়া’দের নজরবন্দী। তাই ‘কিশোর গ্যাং’ নির্বিঘ্নে দিন দিন ভয়ানক রূপে অবতীর্ণ হচ্ছে।

1

দেশে কিশোর অপরাধের কারণসমূহ অবস্থান ও অবস্থা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে কিশোরেরা অপরাধের শিকার। দারিদ্র্যতা, পারিবারিক ভাঙ্গন, পারিবারিক সহিংসতা, বিনোদন সংকট, কর্মসংস্থান সংকট, সামাজিক পরিবর্তন, নেশার অর্থ যোগান, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যসহ বিবিধ বিষয় কিশোর অপরাধের অন্যতম কারণ। তবে রাজনৈতিক পরিবেশও ক্ষেত্র বিশেষে কিশোর অপরাধের কারণ হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষ বিবিধ মতবাদে বিশ্বাসী হয়। রাজনৈতিক দলসমূহ যদি স্ব স্ব দল পরিচালনা এবং রাজনৈতিক মাঠে টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়, তবে সমর্থকদের সমর্থন ধরে রাখা কঠিন। চলমান সমাজব্যবস্থায় নেতৃত্ব শূন্য কিশোর ও তরুণেরা বিবিধ রাজনৈতিক মতাদর্শ হতে বিমুখ হচ্ছে। যার প্রভাবে ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে দেশে নবশক্তির আবির্ভাব হচ্ছে। এরূপ বিপদজনক শক্তির উত্থানে শঙ্কিত সমাজ ও সমাজব্যবস্থা।

এ দেশে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সূচনা হয় ব্রিটিশ শাসন আমলে। ১৮৫০ সালে প্রণীত ‘The Apprentice Act’ কিশোর অপরাধ সংশোধনের লক্ষ্যে প্রথম প্রণীত আইন। পরবর্তীতে ১৮৭০ সালে ‘Reformatory School Act’ নামে দ্বিতীয় আইন প্রণীত হয়। ১৮৯২ সালে প্রিজন কনফারেন্সের সুপারিশক্রমে ভারতবর্ষে কিছু ‘Reformatory School’ স্কুল চালু করা হয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণকল্পে ‘Probation of Offenders Ordinance’ প্রণয়ন করে। এ আইনের আওতায় কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা হয় এবং ঢাকার অদূরে মুরাপাড়ায় ২শত আসন বিশিষ্ট ‘Borstal School Reformatory’ চালু করা হয়। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র কিশোর সংশোধনমূলক প্রতিষ্ঠান। যেখানে অপরাধীদের বিচারিক কার্য শেষে সংশোধনের জন্য প্রেরণ করা হতো। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু প্রবর্তন করেন ‘বাংলাদেশ শিশু অঅইন-১৯৭৪’। এ আইনের আওতায় সমাজকল্যাণ দপ্তর কর্তৃক ১৯৭৮ সালে দেশের কিশোর অপরাধীদের বিচার, নিরাপদ হেফাজত ও সংশোধনের যৌথ উদ্যোগ হিসেবে গাজীপুরে (টঙ্গী) কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এ ধারবাহিকতায় গাজীপুর কোনাবাড়ীতে (মেয়েদের জন্য) এবং যশোর পুলেরহাটে (ছেলেদের জন্য) আরো দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে সরকার সরকার ‘শিশু আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে। এ আইনের আওতায় আইনের সংস্পর্শে আসা এবং আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশুদের কিশোর আদালতের মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে।

2

শিশু-কিশোরেরা দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। তাদেরকে যথা সময়ে নৈতিকতাবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবোধ ধারণে সমৃদ্ধ করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা ও সামাজিক চেতনা জাগ্রতকরণের মাধ্যমে কিশোরদের চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন সম্ভব। সকলকে উপলদ্ধি করতে হবে যে, আদর্শহীন শিশু পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা। দেশের শৃঙ্খলা লঙ্ঘনকারী এবং আদর্শচ্যুত কিশোরদের হেফাজত, সংশোধন ও আত্মশুদ্ধির সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যমান আইনসমূহে কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। কোনো শাস্তির বিধান নাই। কিশোর অপরাধীদের যারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করছে, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শৃঙ্খলিত ও চরিত্রবান শিশু-কিশোরেরাই হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের রূপকার। চারিত্রিক উৎকর্ষিত শিশুরাই হবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার।
  
লেখক: উপপরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর