বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

স্মার্ট সুদহার মূল্যস্ফীতিকে কতটুকু সহনীয় রাখবে?

ঢাকা মেইল ডেস্ক, মো. মাঈন উদ্দীন
প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১১:০৮ এএম

শেয়ার করুন:

স্মার্ট সুদহার মূল্যস্ফীতিকে কতটুকু সহনীয় রাখবে?

২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক স্মার্ট সুদহার চালু করে। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির সিদ্ধান্তের আলোকে স্মার্ট চালু করা হয়। স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে ৩.৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সম্প্রতি এক সার্কুলারে জানানো হয়েছে মার্চ মাসের শুরুতে মার্জিন কমিয়ে স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩.৫০ শতাংশ মার্জিন যোগ করতে পারবে। জুলাই মাসের প্রথম ভাগে স্মার্ট ছিল ৭.১০। সেই হিসাবে সুদের হার ছিল ১০.৮৫ শতাংশ, আগস্টে স্মার্ট রেট ছিল ৭.১৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ৭.২০ শতাংশ, অক্টোবরে হয় ৭.৪৩ শতাংশ, নভেম্বরে ৭.৭২ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৮.১৪ শতাংশ, ২০২৮ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৮.৬৮ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে স্মার্ট রেট এক শতাংশ বেড়ে ৯.৬১ শতাংশে উঠেছে।


বিজ্ঞাপন


স্মার্ট হার প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ মাসে বাড়ে ২.৫১ বেসিস পয়েন্ট বা ৩৫.৩৫ শতাংশ। মূলত স্মার্ট রেট প্রতি ৬ মাসে ট্রেজারি ও বন্ডের গড় সুদহার বের করে হিসাব করা হয়। সেই হিসাবে মার্চের ঋণ বিতরণে স্মার্ট (সিক্স মানথ্স মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) এর নতুন হার নির্ধারণ হয়েছে ৯.৬১ শতাংশ। এর সঙ্গে নতুন মার্জিন যোগ করে সর্বোচ্চ সুদ হার ১৩.১১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রি-সিপমেন্ট রফতানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের ব্যাংক সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে স্মার্ট সুদহারের সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ শতাংশ যোগ করে। এতদিন যা ছিল ২ দশমিক পঁচাত্তর শতাংশ। এর সঙ্গে ১ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে এসএমই ঋণের বিপরীতে।

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক  প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে স্মার্ট (সিক্স মানথ্স মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) সুদহারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২.৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে আমানত নিতে পারবে। আর সাড়ে ৫ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

নতুন সিদ্ধান্তে আমানত ও ঋণে ৫০ বিসিস পয়েন্ট মার্জিন কমলো এনবিএফআই আমানত ও ঋণে। সে হিসাবে এই খাতে আমানতের সুদহার ১২.১১ শতাংশ এবং ঋণে তা ১৫.১১ শতাংশ।


বিজ্ঞাপন


চলমান স্মার্ট রেট অনুসারে ব্যাংকসমুহের ঋণের সুদহার ১৩.১১ শতাংশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমুহের ঋণের সুদহার ১৫.১১ শতাংশ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে সমালোচনা করে স্মার্ট সুদহারকে আনস্মার্ট সুদহার নীতি হিসাবে উল্লেখ্য করেছে। এই সুদহারের ভিত্তিতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়বেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।

আরও পড়ুন

নিত্যপণ্যের দামে অস্থিরতা: জনভোগান্তি কমবে কি!

ব্যবসায়ীরা মনে করেন তারা ব্যবসা করে দেশের বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, লাভের  একটি অংশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধে দেন। সুদের হার এভাবে বাড়তে থাকলে অনেক ব্যবসায়ীর ঋণ খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এতে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছে। যারা পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা করতে গিয়ে খেলাপি হচ্ছেন উভয়ের ক্ষেত্রে একই আইন থাকা ঠিক না। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের আরও দেউলিয়া হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিসের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরীর মতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না। আবার এলসি খুলতে গেলেও নির্ধারিত হারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে বেশি রেট নিচ্ছে। আবার সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট যেখানে ৩৫ শতাংশ ছিল তা এখন ২৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। যার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করতে সমস্যা হচ্ছে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রমান্বয়ে সুদহার বৃদ্ধির উদ্যোগ ভালো হলেও তা ব্যবসা বাণিজ্যের পরিবেশ রক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার প্রতিও নজর দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে এখানে সুদের হার ১২ বা ১৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত না। আমানতের সুদের হার ও ঋণের সুদের হারের মধ্যে যৌক্তিকতা থাকা চাই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন মূলস্ফীতিতে কমাতে এখন আমানত ও ঋণের সুদের হার বাড়ছে এটি ঠিক। সেটা সর্বোচ্চ ১২-১৩ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। এর চেয়ে বেশি হলে যেমন ব্যবসায়ীরা বিপাকে পরবেন, তেমনি ১৭-১৮ শতাংশ সুদের আমানত নিয়ে ব্যবসা করলে সেই ব্যবসাও টিকবে না।

এদিকে ব্যাংকগুলোতে চলছে বর্তমান ঋণ তীব্র তারল্য সংকট। আমানত সংগ্রহের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারের অংকের অনুপাতে ও মেয়াদের আলোকে ১২/১৩ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে আমানতের সুদহারের অফার অত্যন্ত গোপনীয় মাধ্যমে বলা হচ্ছে। এভাবে উচ্চহারে আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো যেমন বিপাকে পড়তে পারে তেমনি আমানতকারীরাও ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

আমানত ও ঋণের সুদহারের বিভিন্ন বাজার ব্যবস্থা ও উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনের গতিপ্রকৃতি কাঙিক্ষত না হলে জনদুর্ভোগ কমার পরিবর্তে আরও বাড়তে পারে।

বাজারের সরবরাহের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোতে এখন ঋণের চেয়ে আমানত প্রবৃদ্ধি কম।

আরও পড়ুন

‘নীতিতে আপোষহীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। করোনার কারণে বিগত দুই বছর ঋণ পরিশোধে ছাড় পাওয়ার ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ও কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেওয়ার মতে তহবিল কমে এসেছে।

আবার শরিয়াভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকও তারল্যের সংকটে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়ায় তারল্যের সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করছে ব্যাংকাররা। কারণ ঋণের কিস্তি পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেক ঋণ গ্রহিতার কিস্তি অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ঋণ আদায়ে ঘাটতি দেখা দিলে অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতি হারাতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ জানুয়ারি ঘোষিত মুদ্রানীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুনের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্যই ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। কিন্তু দেখা গেছে নীতি সুদহারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণের সুদহার বৃদ্ধির পরও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে দীর্ঘসময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়, এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। বিবিএসের তথ্য থেকে দেখা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে (২০২৪) একটু কমলেও খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫৬ শতাংশ ডিসেম্বরে তা ছিল ৯.৫৮ শতাংশে।

জানুয়ারিতে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ । গত ডিসেম্বরে এ খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৫২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বেড়ে যায়। এমনিতে জিনিসের দাম বেশ চড়া। তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্য বহির্ভূত খাতে খরচ বেড়ে গেছে। সবমিলিয়ে মূল্যস্ফীতির এ চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশ লম্বা সময় ধরে দেখা যাচ্ছে। এটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সমন্নিত উদ্যোগের অভাব আছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ চাপ সামাল দেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।

মূল্যস্ফীতির সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত। এক্ষেত্রে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুব একটা সফল নাও হতে পারে। মুদ্রানীতির সঙ্গে ফিস্কেল পলিসির সংযোগ সাধন করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষকের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্যই দরকার সুশাসন, সঠিক ও সময়মতো সংস্কার ও রাজনৈতিক দৃঢ় অঙ্গিকার। 

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর