সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, ভাষার প্রসার হোক বছরব্যাপী

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

সড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যাবে কি

চলছে ফেব্রুয়ারি মাস। ভাষা আন্দোলনের মাস। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্বজুড়ে ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরে রয়েছে বাড়তি আয়োজন। ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বের বাঙালিদের কাছে ভাষার মাস হিসেবে পরিচিত। এই মাসেই ভাষা শহীদ দিবস, যা এখন বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এছাড়াও এই মাসে রয়েছে ভালোবাসা দিবসসহ আরও বেশকিছু দিবস। বর্তমানে বাঙালি তরুণ-তরুণীদের কাছেও এখন এসব দিবস বেশ জনপ্রিয়। এই ভাষার মাসেই প্রেমের কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, ‘তোমার হাতের মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ শুনবার জন্য/দরোজার সঙ্গে চুম্বকখণ্ডের মতো আমার কর্ণযুগলকে/গেঁথে রেখেছিলাম। কোনো নির্জন মধ্যরাতে তুমি এসে/ডেকে বলবে : এই যে ওঠো, আমি এসেছি, আ-মি।’ কবিতার পঙ্ক্তির মতোই বসন্ত ভালোবাসায় একাকার হয়ে যাওয়ার দিন এই ভাষার মাস।

ফেব্রুয়ারি মাস, অমর একুশে গ্রন্থমেলার মাস। ভাষার মাস আসলেই আমরা বাংলা ভাষার ওপর বই প্রকাশ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু বাংলা ভাষাকে আমরা যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কি? সেটা আজ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর। আজও আমরা সাবলীল বাংলা ব্যবহার করতে জানি না। এতদিনে একটা ভাষানীতি গঠন করা যায়নি। ফলে বাংলা বানানের বিষয়টি যে যেমন বোঝে সে তেমনভাবে বানান করে। এখনও উচ্চশিক্ষায় বাংলা বই চালু হয়নি। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে বাংলা ভাষার বই আর পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলা একাডেমি থেকে গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পরবর্তীতে এফএম রেডিও, সামাজিক গণমাধ্যমে সবখানে বাংলা ভাষার ব্যবহারের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। সাইনবোর্ড থেকে বিজ্ঞাপন— সবখানে বাংলার অশুদ্ধ ব্যবহার। ফেব্রুয়ারি এলে সেটা একটু-আধটু বলা হলেও সারা বছর কোনো খবর থাকে না। আমরা বাঙালি। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। অথচ আজও এই বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজও আমরা ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত করা বুলিই অফিস-আদালতসহ সব জায়গাতেই ব্যবহার করছি। ইংরেজদের দেওয়া বুলি ব্যবহার করার জন্য কি আমরা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলাম? আমরা কি সেই বাঙালি, যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলাম। দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম।


বিজ্ঞাপন


১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগের পর থেকে পাকিস্তান বহুমুখী শত্রুতা চালাতে থাকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। বাংলা ভাষাকে শরীর ও আত্মার বিনাশ করাই ছিল পাকিস্তানিদের লক্ষ্য। অনেক আÍত্যাগের বিনিময়ে এই মাসেই উর্দু ভাষা, বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলার দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালিকে একটি হীন, দুর্বলচিত্ত জাতি হিসেবে পরিচয় করিয়েছে ব্রিটিশরা। আজ এই পরিচয়ের কালিমায় সিক্ত হয়ে বাঙালি শাসিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ইতিহাস নানা জটিলতার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলার সোনার ছেলেরা মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য জীবন দিলেন। ইতিহাস পড়ে যাদের নাম আমরা জেনেছি, তারা হলেন— সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। যারা বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করলেন, যারা বাংলার জন্য জীবন দিলেন, যারা বাংলার ভাষার জন্য সম্ভ্রম হারালেন সেই বাংলা ভাষা (আমাদের মাতৃভাষা) কি আমরা সর্বত্র ব্যবহার করছি। করছি না। বাংলা ভাষার পরিবর্তে অফিস, আদালতে, সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হচ্ছে ব্রিটিশদের দেওয়া ইংরেজি ভাষা। কেন বাংলা ভাষা সর্বত্র ব্যবহার করতে পারছি না। সমস্যাটা কোথায়?

মানুষ তারই সঙ্গে শত্রুতা করে, যা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। রাষ্ট্রের শক্তিমান প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন— ব্যাংক, বীমাপ্রতিষ্ঠান, করপোরেশন, বিচারালয়, সচিবালয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউট, বাণিজ্যসংস্থা, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কার্যকলাপে বাংলা ভাষার পরিবর্তে এখনো ইংরেজি প্রাধান্য দিচ্ছে। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্য, বড় বড় দোকান, শপিংমল, কল-কারখানাতেও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হচ্ছে। কেন আজও এসব প্রতিষ্ঠানের নাম পুরোপুরি বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হচ্ছে না। ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে আছে এখন এমন কিছু দল, গোষ্ঠী, শ্রেণি, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা যাদের স্বার্থের পরিপন্থি। তারা সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষার সঙ্গে শত্রুতা করে আসছে। বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা এখনো পুরোপুরি শ্রদ্ধেয় ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। আড়াইশ শতাব্দী আগে তারা শ্রদ্ধা করেছে ফারসি ভাষাকে। গত দু’শ বছর ধরে শ্রদ্ধা করে আসছে ইংরেজি ভাষাকে। দুটিই সাম্রাজ্যবাদী রাজকীয় ভাষা, যা বাঙালির কাছে আভিজাত্যের প্রতীক। আমাদের রুগ্ন সমাজব্যবস্থা এমন কিছু মানুষ ও তাদের একটি শ্রেণি সফল হয়েছে, যারা অসুস্থভাবে হলেও ইংরেজিমনস্ক। সর্বোপরি ইংরেজ শাসনে পিস্ট জাতির মস্তিষ্কে এখনো উপনিবেশ ভর করে আছে।

ভাষা মানুষকে অচল করে দেয়ার প্রধান অস্ত্র। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্প্রদায় দ্বিভাষিক। পারিবারিক জীবনে ও জনতার সামনে তারা ব্যবহার করেন সাধু-চলতি, আঞ্চলিক মিশ্রিত বাংলা ভাষা। আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানগুলোতে তারা ইংরেজিতে বক্তব্য দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমাদের দেশের উচ্চ বিত্তশালীরা তাদের সন্তানদেরকে ইংরেজি ভার্সনে লেখাপড়া করান। তারা বাংলা পছন্দ করেন না। এমনকি এমপি, মন্ত্রী, সরকারি আমলাদের সন্তানরাও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভার্সনে লেখাপড়া করেন। এই জন্যই কি আমরা বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলাম। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা সত্য, আমরা সব কিছুতেই পরনির্ভর, তাই পরের কাছে আবেদন নিবেদনের জন্যে ইংরেজি আমাদের সবসময় দরকার। ইংরেজি ব্যবহারকারীদের ভাবটা এমন পৃথিবীর সব জ্ঞান শুধু ইংরেজিতেই পাওয়া যায়। তাই ইংরেজি অত্যাবশ্যক ইত্যাদি নানা যুক্তি তারা পেশ করেন। তার কারণ ইংরেজি ভাষার দেশ, ইংল্যান্ড-আমেরিকার রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাদের ভাষার প্রসারে যে ভূমিকা রাখে তাতে ইংরেজি বই কিনতেই হয়। যেমন লাতিন আমেরিকায় রাশিয়ার একটা ভালো বই বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেলে ফলে পাঠকের হাতে ইংরেজি বইটাই আগে যায়। প্রসারের এই চেষ্টা আমাদের নেই। এ কারণে ভাষার প্রচার-প্রসার নেই। বাংলা ভাষা আমলাদের কাছে মর্যাদার ভাষা নয়, ইংরেজিকেই তারা মর্যাদার আধাররূপে জ্ঞান করেন। কারণ এটাই তাদের অস্ত্র। তাহলে কি আমরা ধরে নিব, আমলাদের অবহেলা-প্রচার ও প্রসারের অভাবে সরকারি কাজকর্মে এখনো বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি বা হচ্ছে না।

বাংলা ভাষা যত বেশি ব্যবহার হবে, এর প্রতিপত্তিও বেড়ে যাবে। বাংলা ভাষা নিজস্ব স্বভাবেই বেড়ে উঠবে এবং একদিন প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির শীর্ষে আরোহণ করবে, কেবল তখনই এর সক্ষমতাকে অন্য ভাষার পাশে বিচার করা চলবে, তার আগে নয়। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদার বিকাশের শৈশবকাল অতিক্রম করছে। সুতরাং শব্দ, পরিভাষা বা ব্যবহারের জটিলতা থাকবে কিন্তু তা ব্যবহারের মাধ্যমেই কেটে যাবে। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কেননা প্রতিদিনের ভাবের আলাপ, সুখ, দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য, আনন্দ-বেদনার প্রকাশ পায় মাতৃভাষায়। মাতৃভাষা মনোভাব যত উপযোগী অন্য ভাষা তা নয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা সহজেই সে বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারে। মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার সহজবোধ্যতার ভিত্তি নেই। দেশ ও জাতির কল্যাণে তথা দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মায়ের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, দেশের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র গড়তে হলে প্রয়োজন মাতৃভাষা। সবচেয়ে বড় কথা— মাতৃভাষা মায়ের ভাষা, স্বদেশি ভাষা। মাতৃভাষার চেয়ে সহজ অন্য কোনো ভাষা হতে পারে না। ভাষা প্রকাশ হয় সাহিত্য - সংস্কৃতির মাধ্যমে। সেখানে আমাদের ভাষার ব্যাপ্তি কমছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব ও জীবন-যাপন ব্যয়-বহুলতার কারণে সংসারে দুজন চাকরি করছে। ফলে সন্তানটি হয়ে পড়ছে টেলিভিশনকেন্দ্রিক। সেখানে সে যেসব সিরিয়াল দেখছে তা হিন্দি ভাষায় নির্মিত। ফলে হিন্দির প্রতি তার ঝোঁক বাড়ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এখন হিন্দি ভাষার প্রভাবে বাংলা খুবই দুর্বল হচ্ছে। ভাষা ইতিহাস ঐতিহ্যের বাহন। বাংলা ভাষায় সেরা সাহিত্যকর্ম সমূহ বিকশিত হয়ে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি বিশ্বময় বাড়বে। তখনই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়বে। যেটা ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই বাঙালিদের প্রাণের দাবি।


বিজ্ঞাপন


লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর