সাংবাদিক হানজালা শিহাব। আমাদের শিহাব ভাই। ২০১৫ সালে প্রথম পরিচয়। দেখা। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম কথা হয়। একই পত্রিকায় চাকরির সুবাদে খুব অল্প কদিনে আপন হয়ে যাই। আমরা সবাই ছিলাম পরিবারের মতো। মিডিয়ায় নানা গ্রুপিং থাকলেও নতুন বার্তা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। 'কলিগ কখনো হয় না দোস্ত'কে সম্পূর্ণ অসত্য প্রমাণ করেছিল আমাদের টিম। কী অপার আনন্দ-উৎসবের সাথে কাজ করতাম আমরা।
নিউজম্যানের বাইরে আমরা ছিলাম বন্ধু, ভাই ও চিন্তা-চেতনায় কাছাকাছি। কবিতা, গান, গল্প, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কত কথা যে হতো। বিশেষ করে আমার নানা কবিতা নিয়ে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলতেন। নিরপেক্ষ মতামত দিতেন। ভালো লাগা, মন্দ লাগা প্রকাশ করতে অকপটে। একটা সময় বুঝতে পারলাম, তিনিও কবিতা লেখেন। ভালোবাসেন কবিতা।
বিজ্ঞাপন
মাঝে-মধ্যে বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসতেন অফিসে। বলতেন, ‘আপনার ভাবী তো আপনাদের ভালোবাসেন। বারবার বলেন, না এনে পারি না।’ কতবার যে খিচুরি, ইলিশ মাছ, পোলাও এনেছেন হিসাব নেই।
আমার অর্ধাঙ্গী তানজিলা তাসনিম একবার গ্যাস্টিকজনিত সমস্যায় মধ্যরাতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শিহাব ভাইকে ফোন দিই। কারণ ভাবী ঢাকার স্বনামধন্য একটি হাসপাতালের নার্স। সেই মধ্যরাতে ভাবীকে দিয়ে প্রেসক্রিপশন করিয়ে ছবি তুলে ইনবক্স করেন। রাতে এলাকার ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে সেই যাত্রায় রক্ষা পাই। আমি নিজেও অনেকবার তার মাধ্যমে ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছি। দারুণ অমায়িক, প্রচণ্ড হেল্পফুল, ভীষণ আন্তরিক ও সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ ছিলেন আমাদের শিহাব ভাই।
দুই.
গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩০ জুন আমাকে ফেসবুকে নক করেন। ‘জিয়া ভাই, আমি বড় ধরনের রোগে ভুগছি। আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে!’ ছোট এই এসএমএস দেখেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমার পায়ের তলার মাটি সরে যায়। চোখ ভিজে ওঠে। মনে পড়ে প্রয়াত বন্ধু তাজুলের কথা। কাঁপতে কাঁপতে সাথে সাথেই ফোন ব্যাক করি। ওপারে ভারী কণ্ঠ। গলা ধরে আসা কণ্ঠ। আমি নির্বাক। কিছু বলার ভাষা নেই। শুধু বললাম, ‘ভাই, নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।’ আর কিছু বলতে পারলাম না।
বিজ্ঞাপন
এক সপ্তাহ পর বন্ধু আহসান হাবীবকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। কত কথা যে হলো। বারবার বলছিলেন, ‘দোয়া চাই। ঈমানের সাথে যেন বিদায় নিতে পারি।’
তিন.
গত ১৭ সেপ্টেম্বর আমাকে ম্যাসেঞ্জারে লেখেন, ‘আমি ওমরাহ পালন করতে আজকে মক্কায় এসে পৌঁছেছি। ইনশাল্লাহ আপনার আব্বার জন্য দোয়া করবো। আপনাদের সবার জন্য দোয়া করবো। আমার জন্য দোয়া করবেন।’ আমি তাকে আর বিরক্ত করিনি।
মনের আজান্তেই চোখ ভিজে উঠল। বুঝেছিলাম, শিহাব ভাই জেনে গেছেন তার সময় শেষ। আমাদের মাঝ থেকে ছুটি নেবেন। অসহ্য নস্টালজিয়ায় হারিয়ে যাই। বুক ধড়ফড় করে। মনে পড়ে, কতবার যে ঢাকা সাব এডিটর কাউন্সিলের সদস্য পদ বহাল রাখতে আমাকে তাগিদ দিয়েছেন। জোর করে টাকা নিয়ে চাঁদা পরিশোধ করে দিয়েছেন। বলতেন, ‘আপনার এখানে থাকতে হবে। দরকার আছে। ভালো মানুষ সবখানে কাজ করলে দেশের চেহারা বদলে যাবে।’
চার.
শিহাব ভাইকে নিয়ে এভাবে লিখতে হচ্ছে, সত্যিই মেনে নিতে পারছি না। কত কত উজ্জ্বল স্মৃতির সঙ্গী তিনি। সাগরকন্যা পটুয়াখালী জেলায় শিহাব ভাইয়ের বাড়ি। এই সুবাদে কতবার বলেছি, ‘আপনার এলাকায় আমার ভালোবাসা পড়ে আছে। কতবার গিয়েছি। কত স্মৃতি জড়ানো। কত আবেগ জড়ানো!’ বলতেন, ‘চলেন। আবার যাই। আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবো সব!’
আমাদের সময় মেলে না। যাওয়া হয় না। যাওয়া হয়নি। শিহাব ভাই ঠিকই চলে গেলেন। পটুয়াখালীতেই গেলেন। একেবারেই চলে গেলেন। না ফেরার দেশে। ফুটফুটে দুই সন্তাকে নিয়ে আর গল্প করবেন না। গল্প করবেন না আগামী দিনের ঝলমলে স্বপ্নের। অন্য আলোয় ভালো থাকবেন, শিহাব ভাই। আমাদের স্বপ্নের চেয়ে ভালো। জান্নাতুল ফিরদাউসের সুশীতল আশ্রয়ে স্বপ্ন দেখুন। আমরাও আপনাকে স্বপ্নে দেখবো। দেখবো আপনার শান্তির আশ্রয়স্থলে আপনি একদল সত্যবাদীর সাথে হাসছেন। পূণিমা চাঁদের মতো জ্বলছে আপনার নুরানি চেহারা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

