রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক

দীপংকর গৌতম
প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:২৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক

গত ৭ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টায় ‘হামাসের’ প্রতিরোধ যোদ্ধারা ফিলিস্তিনের গাজা থেকে ইসরায়েলে আচমকা সমন্বিত আক্রমণ চালায়। জল, স্থল ও আকাশপথে একযোগে হামলা। হামাসের যোদ্ধারা প্রায় পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে। রকেট আক্রমণের আড়ালে শক্তিশালী লোহার সীমান্তবেড়া গুঁড়িয়ে ইসরাইলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেনানিবাসসহ প্রায় ২১টি স্থানে আক্রমণ চালানোর পর সম্বিত ফিরে পায় ইসরায়েল এবং প্রতিআক্রমণ শুরু করে।

এরপর ৮ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল সর্বশক্তি নিয়ে গাজার নিরাপরাধ মানুষদের ওপর প্রতিআক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, ‘গাজাকে আমরা জনমানবশূন্য দ্বীপে পরিণত করব।’ ফলে গাজার জনবহুল এলাকাগুলোতে অনবরত বড় ধরনের হামলার অংশ হিসেবে খাদ্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে লাগাতার বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল এবং সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করেছে। ইসরায়েলি বাহিনী ‘পোড়ামাটি নীতি’ অবলম্বন করে পুরো গাজাকে ধুলায় পরিণত করবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।


বিজ্ঞাপন


গাজার একটি হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৫০০ নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুতে ইহুদিবাদী দেশটি এবং এর পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমাদের প্রতি ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে মুসলিম বিশ্ব। ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মুসলিম বিশ্বের নেতারা। এই অকল্পনীয় গণহত্যার বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিক্ষোভ চলছে।

কিন্তু এরমধ্যেও অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। প্রতি মুহূর্তে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। ১২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে হাসপাতাল চত্বরে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেকে। সেখানেই মঙ্গলবার রাতে চালানো হয় ভয়াবহ হামলা। মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ আর আহত মানুষে হাসপাতাল ভরে গিয়েছিল। চিকিৎসকরা যাকে পেয়েছেন চিকিৎসা দিয়েছেন। কিন্তু হতাহত মানুষের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে চিকিৎসকদের অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। এভাবেই গত মঙ্গলবার রাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে গাজার আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার ভয়ঙ্কর সেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী চিকিৎসক নাইম।

২০০৭ সালে গাজায় হামাস নির্বাচিত হওয়ার পর ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের পাঁচ দফা যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কখনো অবরুদ্ধ গাজার কোনো হাসপাতালে এতটা ভয়াবহ হামলা চালানো হয়নি। হাসপাতালে ভয়াবহ এই হামলা পুরো বিশ্বকে হতভম্ব করেছে।

আল-জাজিরায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বহুতল হাসপাতাল ভবন থেকে গাঢ় ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠছে। চারদিকে কেবল মানুষের আর্তনাদ। হাসপাতাল ও এর আশপাশে নারী-শিশুসহ মানুষের নিথর দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভবনের চারপাশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালে ইসরায়েলর এই হামলা পরিষ্কার গণহত্যা। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আকাইলাও এ কথা বলেছেন। হাসপাতালে নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই বাস্তুচ্যুত মানুষ।


বিজ্ঞাপন


কিন্তু ইসরায়েল অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো প্রথমে হামাস এবং পরে ফিলিস্তিন ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) যোদ্ধাদের এই হামলার জন্য দায়ী করেছে। ইসরায়েল পরে একটি ভিডিও প্রকাশ করে বলেছে, হাসপাতালে হামলার এই ভিডিও ড্রোন দিয়ে ধারণা করা। এটা দেখিয়ে তারা দাবি করছে, ইসরায়েল এই হামলার জন্য দায়ী নয়। কারণ, হাসপাতাল ভবনে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা হামলার চিহ্ন নেই।

সংঘাত শুরুর পর ১২ দিনের হামলার তুলনায় গত মঙ্গলবারের হাসপাতালে হামলা ছিল ভয়ঙ্কর। এই হামলা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিল, প্রথমে ইসরায়েলিরা নিজেদের বাড়িতে হত্যার শিকার হয়েছেন। এরপর ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো নিজেদের বাড়ি ও হাসপাতালে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে। জীবিতদের খোঁজে উদ্ধারকর্মীরা হাসপাতালে রক্তমাখা ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছেন।

ইসরায়েলি বোমায় গাজা যখন জ্বলছিল, আহত ও আতঙ্কিত মানুষের আর্তচিৎকারে যখন চারদিকে এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল, তখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে বাইডেন যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেন। দশকের পর দশক পশ্চিমা দেশগুলোর সম্মতি ও অনুপ্রেরণায় ইসরায়েল সরকার একটু একটু করে যে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল হামাসের আক্রমণের পর থেকে তারা বাকিটুকু ষোলকলায় পূর্ণ করতে চাইছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার জাতিবিদ্বেষী মন্ত্রিসভার সদস্যরা বহুদিন ধরেই গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে চাইছিলেন। এই দানবীয় পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর। তার মতো ঘৃণিত মানুষই পারেন পৃথিবীর বুক থেকে গাজাকে মুছে দিয়ে ফেলা। এটা মোটেই ন্যায়সঙ্গত জবাব বা প্রতিশোধ নয়।

অন্তহীন দুর্দশা ফিলিস্তিনিদের ওপর ঠাণ্ডা মাথায় চালানো একটি ‘গণহত্যা’। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অঞ্চলের সমস্যার সমাধান নিয়ে কোনো তৎপরতা না দেখিয়ে বরং একটি বর্বরতম অধ্যায়ের দিকে এগাচ্ছে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যস্ততাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে দুটো রণতরী পাঠিয়েছে ইসরায়েলের সমর্থনে। কি অসাধারণ মধ্যস্ততাকারী! এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সমর্থনে তাদের সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। আর এখন আমাদের দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য মরিয়া। তাদের ফিলিস্তিন নীতি দেখে যে কেউ বুঝবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো আরেকটি অস্ত্রবাজার পেয়ে গেছে। তাদের প্রচ্ছন্ন মদদে ফিলিস্তিনে শুধু গণহত্যাই চলছে না, গাজার প্রতিটা ইঞ্চির মতো গাজাবাসী ও তাদের স্মৃতিকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়াই হলো এবারকার ইসরায়েলি হামলার উদ্দেশ্য।

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তথাকথিত আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সবসময়ই দোষী, ষড়যন্ত্রকারী আর ইসরায়েলিরা সবসময় নিষ্পাপ। কাজেই ফিলিস্তিনিদের ওপর যা ইচ্ছা তাই করুন। ফিলিস্তিনিদের খাবার ও পানি অবরুদ্ধ গাজায় সব বন্ধ করে দিতে পারেন। আদতে গাজাকে ২০০৫-এর ফালুজাতে রূপান্তরের চেষ্টা হচ্ছে।

কিন্তু গাজার হাসপাতালে হামলা সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। এই ঘটনা পুরো বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। তুরস্ক, জর্ডান, মিসর, ইরাক, ইরান, তিউনিসিয়া, লেবাননসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। ফিলিস্তিনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। হামলার নিন্দা জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি, জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ প্রমুখ।

ফিলিস্তিনে এই গণহত্যার মধ্যেই গত বুধবার ইসরায়েল সফর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি ইহুদিবাদী দেশটির প্রতি দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং গাজার হাসপাতালে হামলায় ইসরায়েল দায়ী নয় বলে মন্তব্য করেছেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি দাবি করেছেন, হামলায় ‘অন্য পক্ষ’ দায়ী।

মধ্য গাজার আল–আহলি আল–আরাবি হাসপাতাল চত্বরে এরইমধ্যে একটি নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন আরব নেতারা। ইসরায়েল সফর শেষে জর্ডান, মিসর ও ফিলিস্তিনি নেতাদের সঙ্গে আম্মানে বাইডেনের বৈঠক করার কথা ছিল। হাসপাতালে হামলার প্রতিবাদে তারা বৈঠকটি বাতিল করে দিয়েছেন।

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ওই হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে বর্ণনা করেছেন। সৌদি আরব এ হামলাকে ‘ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর সংঘটিত জঘন্য অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বলেছেন, ইসরায়েলি হামলা যে ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না, এটি তার সর্বশেষ নজির। আমি গাজায় এই নজিরবিহীন বর্বরতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান মুসা ফাকি মাহামত এ হামলায় ইসরায়েলকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। এই বর্ববরতার বিরুদ্ধে বিশ্বের মানবিক সব মানুষকে একাত্ম হয়ে ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায় তোলার জন্য দাবি জানানো প্রয়োজন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর