সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

জলবায়ু পরিবর্তন, বাংলাদেশ ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড

মো. বোরহানুল আশেকীন
প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

জলবায়ু পরিবর্তন, বাংলাদেশ ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড

গলছে মেরুর বরফ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। দেশে দেশে হচ্ছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়। বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ, হারাচ্ছে কৃষি জমি। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র, তৈরি হচ্ছে পানির সংকট। হুমকির মুখে প্রাণ ও প্রকৃতি। আর বিরুপ এমন অবস্থার জন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন। আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মানুষের কর্মকাণ্ড।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গেল ২০০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী মানুষ, যারা ব্যবহার করছে জীবাশ্ম জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল, গ্যাস) ব্যবহারের জন্য তৈরি হচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস (র্কাবন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড)। বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরনের অর্ধেক হচ্ছে সাতটি জায়গায়। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, ব্রাজিল, রাশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় হচ্ছে কার্বন নিঃসরণ সবচেয়ে বেশি।


বিজ্ঞাপন


জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে ১৮০০ সালের পর থেকে বিশ্বে বেড়েছে তাপমাত্রা। শিল্পবিপ্লব পূর্বে এবং ১ লাখ বছরের চেয়ে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর জলবায়ু পরিবর্তনের মাসুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ জনগণকে।

বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের মাত্র ০.৫ শতাংশ হচ্ছে বাংলাদেশে। ২০২১ সালের কার্বন রিস্ক ইনডেক্স জানাচ্ছে কার্বন নিঃসরণের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিগ্রস্থ দেশের তালিকায় সপ্তম অবস্থানে বাংলাদেশ। কার্বন রিস্ক ইনডেক্স এর মতে ২০০০-২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষ মারা গেছে, ৩.৭১ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং ১৮৫টি বিরুপ আবহাওয়া সম্মুখীন হতে হয়েছে।

ভয়ঙ্কর তথ্য দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ৭.১ মিলিয়ন মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে, আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫০ নাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৩.৩ মিলিয়নে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি সাত জনের একজন স্থানচ্যুত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বাড়লেই মোট ভূমির ১১ শতাংশ হারাবে বাংলাদেশ এবং ১৮ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২১০০ সালের মধ্যে ৫ থেকে ৬ ফুট সমুদ্রের উচ্চতা বাড়লে, ৫০ মিলিয়ন মানুষ তার জায়গা জমি হারাবে।


বিজ্ঞাপন


ইউনিসেফ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ১৯.৪ মিলিয়ন শিশু হুমকির মুখে আছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিখাতে। একই সাথে বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যখাতে।

জলবায়ু পরিবর্তনরোধে বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের উপর। যে কার্বণ নিঃসরন হচ্ছে তার মাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে কমিয়ে আনতে হবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা রাখতে হবে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।

লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড

দীঘদিন ধরেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ক্ষতিপূরণের দাবি করে আসছিলে। ১৯৯১ সালে ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের জোট এওএসআইএস, একটি দাবি উত্থাপন করে। যেখানে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপ রাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু দাবিটি আমলে নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০১২ সালে কপ’১৮ তে একই প্রস্তাব তোলা হয়। কপ’১৯ এ ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজম ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ তৈরি করা হয়। ২০১৫ সালে কপ’২১ প্রস্তাবনায় সুনির্দিষ্টভাবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে একটি অনুচ্ছেদ রাখা হয়।
 
অবশেষে গেলো বছর কপ’২৭ অনুষ্ঠিত হয়, মিশরের শার্ম আল শেখে। যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো চারটি উপভাগে বিভক্ত হয়। যাদের মধ্যে ছিল ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের জোট, স্বল্পোন্নত দেশের জোট, আফ্রিকার জোট এবং লাতিন আমেরিকার জোট। যাদের চেষ্টায় যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠনের। আর এই তহবিলের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আর্থিক সহায়তা পাবে।

উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় এই তহবিলে অর্থ দেবে তারা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় কোনো দেশ এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ দেয়নি এই তহবিলে। তবে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি কয়েকবার বৈঠকও করেছে। আশা করা হচ্ছে, কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত আসছে কপ’২৮ এ উপস্থাপন করবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিরোধে দরকার লক্ষ কোটি ডলার। তবে শুরুতেই দরকার ১০০ বিলিয়ন ডলার। যা থেকে সহায়তা পাবে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ। এমনকি বাংলাদেশও লাভবান হবে এই ফান্ডের মাধ্যমে। 

এবারের জলবায়ু সম্মেলন বা কপ’২৮ হতে যাচ্ছে দুবাইতে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতি নির্ধারকরা অংশ নেবেন। অংশ নেবেন বেসরকারি সংস্থার কর্তাব্যক্তিরাসহ জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। শিল্পবিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে বিশ্ব নেতারা উদ্যোগী হবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এই সম্মেলনেই গঠন করা হবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড।

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, চ্যানেল 24

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর