সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও সামাজিক অঙ্গীকার

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
প্রকাশিত: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:১৩ এএম

শেয়ার করুন:

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও সামাজিক অঙ্গীকার

মানুষ বিবেকবোধ সম্পন্ন জীব। মানবীয় মূল্যবোধ, আদর্শ ও সমাজিক প্রথা অনুসরণের মাঝে মানবের চারিত্রিক উৎকর্ষতা প্রকাশ পায়। মানুষ কৃতকর্ম ও আচার-আচরণে সংযত হবে, তা সমাজের সকলের প্রত্যাশা। কিন্তু সমাজে দেখা যায় ভিন্নরূপ। অহংহার, প্রতিহিংসা, অতি লোভ ও দ্রুত ধনী হওয়ার তাড়না মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধর্মীয় অনুশাসন অমান্য, প্রচলিত আইন ভঙ্গ করা, রীতি-নীতি লঙ্গন করা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ দুর্বৃত্তায়নে লিপ্ত। এতে এক শ্রেণির মানুষ অতি দ্রুত বিত্তবান হচ্ছে এবং অপর দিকে সাধারণ মানুষ চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান পরিবর্তিত সমাজে আত্মকেন্দ্রিক মনোবৃত্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ সর্বক্ষেত্রে কূটকৌশলী হচ্ছে। প্রচলিত বিধি-বিধান লঙ্ঘনে কুণ্ঠাবোধ করছে না। ফলে সমাজের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোসমূহ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমাজ কাঠামোর স্তরে স্তরে অশুদ্ধ চর্চা সর্বত্র অস্থিরতা বিরাজ করছে।

বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ‘শুদ্ধাচার’ একটি অতি পরিচিত শব্দ। রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে ‘শুদ্ধাচার’ শব্দটির বহুল প্রচার হচ্ছে। ‘শুদ্ধাচার’ কী এবং এর প্রয়োজনীয়তা কি? শুদ্ধাচার কথাটির শাব্দিক বিশ্লেষণে পাওয়া যায় ‘শুদ্ধ’ ও ‘আচার’। অর্থাৎ ব্যক্তিগত আচরণের উৎকর্ষতা বুঝায়। শুদ্ধাচার শব্দের ব্যবহার বহুবিধ। যেমন: বিশ্বাসযোগ্যতা, সাধুতা, সততা, নৈতিকতা, সুনীতি, ন্যায়পরায়ণতা, সম্মান, সৎ চরিত্র, শালীনতা, আন্তরিকতা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি।


বিজ্ঞাপন


সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তির পৃথক পৃথক ভূমিকা আছে। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তবে সমৃদ্ধ হবে রাষ্ট্র। ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচার বলতে কর্তব্য নিষ্ঠা, সমাজের নীতি ও প্রথার প্রতি অনুগত্য প্রদর্শনকে বুঝায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় শুদ্ধাচার হচ্ছে- নির্ধারিত আইন, বিধি-বিধান ও নীতিমালা যথাযথ অনুসরণ করার চর্চা। এ রূপ শুদ্ধ চর্চার মাধ্যমে সমাজের সর্বত্র শান্তি ও স্বস্তি বিরাজ করে। শুদ্ধাচার চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হ্রাস পায় এবং সম্পদের সুসম বন্টন সুনিশ্চিত হয়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় শুদ্ধাচার ধারণার উৎস কী? আমরা হয়তো অনেকেরই অজানা। এ শুদ্ধাচার ধারণার প্রাথমিক উৎস স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরার কথা উল্লেখ আছে। বাঙালি জাতির গর্বিত অর্জন মহান স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংবিধানের মহান অঙ্গীকার বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সংবিধানের  ১০নং অনুচ্ছেদে একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ২০ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার সাধারণ নীতি হিসেবে ‘অনুপার্জিত’ আয় ভোগ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বুদ্ধিভিত্তিক শ্রম ও কায়িক শ্রমকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও অবিসংবাদিত নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জাতীয় উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সংস্কার প্রত্যেক ক্ষেত্রে জাতীর প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। প্রদত্ত ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “... সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।”

এ উপমহাদেশের মানুষ দীর্ঘকাল বিদেশি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা শোষিত। ভিনদেশী শাসকগণ ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য স্বার্থবাদ শ্রেণি তৈরি করে। স্বার্থবাদীরা হীন স্বার্থে বিদেশি শাসকদের তুষ্ট করার জন্য দেশে দেশে অরাজকতা কায়েম করে। এ ধারাবাহিকতায় দেশের সমাজ কাঠামো ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় আজও বিবিধ অসঙ্গতি পরিলক্ষিত। সমাজকাঠামোতে নৈতিক মানদণ্ডসমূহ প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। ফলে নাগরিকের জীবন যাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যহত হচ্ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা সুযোগে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। প্রতারকচক্র দুর্বৃত্তায়ন করছে কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগত করছে প্রতিনিয়ত। এ ব্যবস্থ একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তরায় এবং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা।


বিজ্ঞাপন


যে কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার। স্বাধীনতা পরবর্তী জাতির জনকের আদর্শ ধারণ করে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী হন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে তিনিই এগিয়ে আসেন। গ্রহণ করেন সংস্কারমূলক বিবিধ সামাজিক নীতি ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কিন্তু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধক দুর্নীতি। এ দুর্নীতি প্রতিরোধে বিবিধ আইন ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। প্রয়োজন সমন্বিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সামাজিক আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এ ধারাবাহিকতায় দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশ কিছু আইন প্রণীত হয়েছে। যেমন: দুর্নীতি দমন আইন-২০০৪, তথ্য অধিকার আইন-২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯, সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা-২০০৯, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০১২, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ ইত্যাদি।

আমাদের সংবিধানিক অঙ্গীকার একটি ন্যায়ভিত্তিক ও শুদ্ধাচারী সমাজ প্রতিষ্ঠা। এ লক্ষ্যে সমাজের সকল পক্ষকে শুদ্ধাচারের আওতায় আনতে হবে। একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত ও শুদ্ধাচারী রাষ্ট্র কায়েম করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সভাপতিত্বে বিগত ১৮ অক্টোবর ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল-২০১২’ গৃহীত হয়। সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সুশাসন ও দুর্নীতি রোধের উপর গুরুত্বারোপ করে। দেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘রূপকল্প-২০২১’ এ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। এ কৌশল পত্রের রূপকল্প হচ্ছে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা এবং অভিলক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এ কৌশলপত্র একটি সামাজিক জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্রীয় দলিল। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি নির্মূল কোনো একক পক্ষের মাধ্যমে সম্ভব নয়। প্রয়োজন সকল পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এ কৌশল প্রণয়ন করা হয় পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকের মতামত নিয়ে। এক্ষেত্রে মোট ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ১০টি এবং অ-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ৬টি। রাষ্ট্রীয় প্রথিষ্ঠানসমূহ: নিবার্হী বিভাগ ও জনপ্রশাসন, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহা সিাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ন্যায়পাল, দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকার। অ-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ: রাজনৈতিক দল, বেসরকারি খাতের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও সুশীল সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম।

রাষ্ট্রীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। নাগরিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সততা, শুদ্ধতা ও নৈতিকতার চর্চা ব্যক্তির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে। নাগরিক শুদ্ধতা জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য সহায়ক। এতে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নিশ্চিত হয় এবং জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সমাজের কিছু অসাধু বা অসৎ প্রকৃতির ব্যক্তি শঠামী, কুটকৌশল ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের অধিকারী হচ্ছে। এরূপ উপার্জন ‘অনুপার্জিত আয়’ হিসেবে বিবেচিত। যে উপার্জনে কোনো শারীরিক বা মানসিক শ্রম নেই, শুধুমাত্র ব্যক্তিই সে উপার্জনে লাভমান হয়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় সমাজব্যবস্থা ও গোটা দেশ। ‘অনুপার্জিত’ আয় রোধ হোক এবং ‘শুদ্ধাচার’ প্রতিষ্ঠা করা হোক আমাদের সামাজিক অঙ্গীকার।

লেখক: সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর