মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ডলারের বিকল্প হতে পারে ব্রিকস কারেন্সি

বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ
প্রকাশিত: ২৪ জুলাই ২০২৩, ০৪:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ডলারের বিকল্প হতে পারে ব্রিকস কারেন্সি

গত ৮০ বছর যাবত বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলার কর্তৃত্ব করছে। এর মূল কারণ হলো আমেরিকার শক্তিশালী অর্থনীতি এবং রাজনীতি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৮ শতাংশ ডলারে সমন্বয় হয়। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে ডিডলারাইজেশন অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা, পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম চলছে। ফলে ডলার কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) সফর করেছেন। ওই সফর দুই দেশের অর্থনীতির জন্য এক মহাগুরুত্বপূর্ণ সফর বলে আমি মনে করি। নরেন্দ্র মোদি ফ্রান্স সফর শেষ করে সরাসরি ইউএইতে পৌঁছেন। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সফরে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ভবিষ্যতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ভারতের যত ধরনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সংঘটিত হবে তার মূল্য লোকাল কারেন্সিতে পরিশোধ বা সমন্বয় করা হবে মর্মে দুই দেশের প্রধানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই ধরনের চুক্তি মার্কিন ডলারের আধিপত্য কমাবে, আন্তর্জাতিক লেনদেনর খরচ কমাবে এবং উভয় দেশের সংরক্ষিত ডলারের রিজার্ভ অক্ষুণ্ন থাকবে।

DD

এখানে উল্লেখ্য, ভারত বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের Common Portion টুকু বা সমপরিমাণ লেনদেনের অংশটুকু লোকাল কারেন্সিতে সমন্বয় করার কার্যক্রম ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক - বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- রিজার্ভ অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) শুরু করেছে। দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয়ের লক্ষ্যে ইউএই এবং ভারত একটি "Real Time Payment" লিংক ডেভেলপ করেছে। যার মাধ্যমে "Cross Border Currency Transfer" সহজ এবং মসৃণ হবে।

RBI এবং UAE- এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে মর্মে RBI ১৫ জুলাই ২০২৩ তারিখে একটি পত্র জারি করেছে। ওই পত্রে সংঘটিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মূল্য মসৃণভাবে রিয়্যাল টাইম পেমেন্ট সিস্টেম-এ পরিশোধের জন্য দুটি বিষয় ডেভেলপ করেছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে:


বিজ্ঞাপন


  1. i) Establish a Framework to Promote the use of Local Currencies for Cross Border Transaction; এবং ii) Co-operation for Interbank Payment and Messaging System.

অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিক লেনদেনগুলোর মূল্য লোকাল কারেন্সিতে সমন্বয় এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্রিয় সহযোগী হিসেবে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে এই দুই দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই অবস্থাকে মার্কেটিং-এর ভাষায় - "Win Win Situation" বলা হয়।

লোকাল কারেন্সিতে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন সমন্বয় করার আরেকটি মৌলিক উদ্দেশ্য হলো- উভয় দেশের কারেন্সি কনভারসন কস্ট কমানো।

আমেরিকা চায় বিশ্বের সকল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য মার্কিন ডলারে পরিশোধ বা সমন্বয় হোক। অন্যদিকে আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি যেমন- চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা ডলারের বিকল্প হিসেবে লোকাল কারেন্সিতে আন্তর্জাতিক লেনদেনের মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয় করতে চায়।

বর্তমানে ভারত এবং ইউএইর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা কিছু দিনের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়াবে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, জনসংখ্যার দিক থেকে ভারত বিশ্বে প্রথম এবং বিশ্ব বাজারের দিক থেকে টপে রয়েছে। ভারত বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম ক্রুড ওয়েল বা অপরিশোধিত তেল আমদানিকারক দেশ।

বর্তমানে ইউএই-এর সাথে ভারতের ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্যের মূল্য মার্কিন ডলারে পরিশোধ বা সমন্বয় করা হয়।

ব্রিকস (BRICS - ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন এবং সাউথ আফ্রিকা) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয় মার্কিন ডলারের পাশাপাশি বা বিকল্প মুদ্রা হিসেবে নতুন কারেন্সি উদ্ভাবনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইরাকও চাচ্ছে চীন, ভারত এবং অন্য দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যগুলোর মূল্য লোকাল কারেন্সিতে পরিশোধ বা সমন্বয় হোক যাতে করে মার্কিন ডলারের রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।

ডলার রিজার্ভ সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে দেখেছি। একইভাবে পাকিস্তানে ডলার সংকটের কারণে দীর্ঘদিন আমদানি নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। যার ফলে, সে দেশে মূল্যস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফ বিভিন্ন শর্ত পরিপালনসাপেক্ষে পাকিস্তানকে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেইল আউট প্যাকেজ ঋণ অনুমোদন করে।

ভারতের কাছে বর্তমানে ৬০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে। তারপরও তারা মার্কিন ডলারের রিজার্ভ যেন ভবিষ্যতে না কমে সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সাথে লোকাল কারেন্সিতে দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয় করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বিশ্বের সব অর্থনীতি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। হোক সেটা আমেরিকা কিংবা আফগানিস্তান।

SSSS

সৌদি আরব চীনের সাথে তার সকল দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের মূল্য লোকাল কারেন্সিতে পরিশোধ বা সমন্বয় করবে মর্মে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। এই দ্বিপাক্ষিক লেনদেনগুলোর মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয়ের জন্য SWIFT সিস্টেমের মতো সংশ্লিষ্ট দুই দেশ নতুন একটি Payment এবং, Messaging  System সৃষ্টি করবে। বর্তমানে SWIFT যেভাবে আন্তর্জাতিক লেনদেনগুলো সম্পাদন করে ঠিক একইভাবে নতুন Payment সিস্টেমও দ্বিপাক্ষিক লেনদেনগুলোর মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয় করবে।

নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সংঘটিত বাণিজ্যিক লেনদেনগুলোর মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয়ের লক্ষ্যে একটি "Unique Payment  and Messaging" সিস্টেম ডেভেলপ করেছে।

ভারত এবং UAE এর মধ্যে সংঘটিত বাণিজ্যিক লেনদেনগুলোর মূল্য পরিশোধ বা সমন্বয় করার জন্য RBI-এর Payment System - "Unified Payment Interface" এবং UAE- এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের Payment System - "Instant Payment Platform" একসাথে ইন্টিগ্রেট করবে।

এই ইন্টিগ্রেটের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান রুপি (Indian Currency) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিরহাম (UAE's Currency) রিয়্যাল টাইম ট্রানজেকশন পেমেন্ট মসৃণভাবে সম্পন্ন হবে। পেমেন্টের এই ইন্টিগ্রেট সিস্টেম ছাড়াও কার্ড সিস্টেম চালু করা হবে। অর্থাৎ ভারতের 'Rupee' কার্ড এবং UAE - এর 'Switch' কার্ড এর মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের পেমেন্ট সম্পন্ন করা যাবে। এই পদ্ধতিতে দ্বিপাক্ষিক লেনদেনগুলোর মূল্য লোকাল কারেন্সিতে সমন্বয় করা হলে, উভয় দেশের ডলারের রিজার্ভ অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং লেনদেনের খরচ অর্থাৎ কারেন কনভারসন কস্ট কমে যাবে।

নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান গত ৩০ বছর যাবত SWIFT - ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পন্ন করতে পারছে না। যার ফলে ইরান বার্টার সিস্টেম বা বিনিময় প্রথা কিংবা লোকাল কারেন্সির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন সমন্বয় করছে। রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি দেশের মতো যদি বড় বড় অর্থনীতি যেমন ভারত, চীন, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা'র ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তবে সংশ্লিষ্ট দেশ SWIFT ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক লেনদেন সমন্বয় করতে পারবে না।

সেই লক্ষ্যে ব্রিকস (BRICS) ডলারের বিকল্প হিসেবে নতুন মুদ্রা চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়, তবে সেই কারেন্সি'র নাম হতে পারে ‘ব্রিকস কারেন্সি’।

লেখক: এজিএম এবং ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, বিডিবিএল, কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চ

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর