পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত ও আলোচিত শব্দ ভালোবাসা ও ঘৃণা। ভালোবাসা সৃষ্টি হয় ভালোবাসার মধ্যদিয়ে। আর ঘৃণা সৃষ্টি হয় ঘৃণার মধ্যদিয়ে। ঘৃণা নয়, আসুন ভালোবাসি। ভালোবাসার অনুভূতি সর্বত্র এবং সবসময়ের জন্য একই— এ কথা ঠিক না। কারণ বাংলাদেশে বিষয়টি অন্যরকম। আসুন তাহলে জানি কিছু অপ্রিয় সত্য কথা।
সমাজের নামি-দামি, জ্ঞানী-গুণী বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকে আমরা অতিমাত্রায় যখন সম্মান করি তখন বনের একগুচ্ছ ভুলকে একত্রিত করে মালা গেঁথে গলায় পরিয়ে দেই। পৃথিবীতে এতকিছু থাকতে বনের একগুচ্ছ ফুল মালা হয়ে গলায় ঝুলে পড়ে। সেই ফুলের জন্মের শুরু থেকে তার ফল হয়ে গড়ে ওঠার সময়টি কিভাবে কেটেছে, তা কি কখনও আগ্রহের সাথে কেউ জানতে চেয়েছে? আমি প্রকৃতির সাথে বেশ সময় কাটাই। আমি শুধু ফুল নয়, ফুলের উৎসকেও ভালোবাসি।
বিজ্ঞাপন
‘যাহার গলে আমি বনমালা/আমি যার কথার কুসুমডালা’ কথাটি মনে খুব ধরেছে। আমি সমাজের তথা বর্তমান বিশ্বের একজন অত্যন্ত আলোচিত মানুষ যার জন্মের শুরু বনের ফুলের মতো অচেনা, অজানা। অথচ সেই মানুষটি আজ সারা বিশ্বের এক আলোচিত ব্যক্তি! হ্যাঁ, নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন হতে চলেছে জিরো থেকে হিরো— হিরো আলম। তার কিছু নেই, আবার সব আছে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, অথচ সে শিক্ষিত। শুধু শিক্ষিত নয়, স্ব এবং সুশিক্ষিত— এটাই সবার মনে, ধ্যানে, জ্ঞানে, দেহে, রক্তে, বলতে গেলে পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সর্বাঙ্গে দাহ হয়ে জ্বলছে। জ্বলার ফলে যে জ্বালা শরীরে উঠেছে তাকে নিভানো বড় দুষ্কর এখন।
আমি যখনই তার কথাগুলো শুনছি তখনই মুগ্ধ হয়ে ভাবছি। ভাবছি, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই কি মানুষের মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী? প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা কি মানুষের মগজকে চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে? যেমনটি ধ্বংস করছে এক ধরনের শামুক যাকে বলা হয় হত্যাকারী শামুক ( killer snail )। এই হত্যাকারী শামুক আমার লাউ গাছের শাখা উপশাখা প্রশাখাসহ গাছকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে যাতে করে সে গাছ আর না বাঁচতে পারে। প্রকৃতির মাঝে এ এক নিষ্ঠুর ভয়ংকর প্রাণী, যা এর আগে দেখিনি। এই নিষ্ঠুর প্রাণীর যখন দেখা মিলল তখনই কেন যেন মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে অতীতের সব পুঁথিগত বিদ্যা কি আমাদের শিক্ষার সীমানাকে একটি গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চেষ্টা করছে? তা না হলে ভিন্ন চিন্তা চেতনার মানুষের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নরূপ কেন?
প্রতিটি মানুষ তার নিজের চেতনা দ্বারা যদি নিয়ন্ত্রিত হতে চায় কেন তাকে অবহেলা? কিছুদিন আগে হিরো আলমের একটি বিবৃতি আমার নজর কেড়েছে। সে বলছে, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার নেই তবে পারিবারিক শিক্ষা আছে। হয়তো বিশ্লেষণে তার কথার সঠিক তথ্য ফুটে ওঠেনি। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে কি? সে যখন তার মতো করে পারিবারিক রেফারেন্স ব্যবহার করে শিক্ষাকে নতুন ফরম্যাটে তুলে ধরছে তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাকে অরুচিপূর্ণ বা রুচি বিকৃতির এক নতুন চমক বলে মনে করছে। আমি রুচি বা অরুচি নিয়ে মত-দ্বিমত রাখতে চাই না। তবে রিফ্লেক্ট করতে চাই যে বিষয়গুলো নিয়ে তা হলো, হিরো আলম পুঁথিগত শিক্ষাকে উপেক্ষা করেনি। তবে নিজের মেধাকে ধাপে ধাপে কাজে লাগিয়ে নিজের কর্মের প্রতি শতভাগ বিশ্বাস স্থাপন করে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। এতে তার প্রতি আমার সম্মান বেড়েছে। হিরো আলম তার নিজের প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করছে এমন একটি সময় যখন বিশ্বের শিক্ষিত সমাজ নোংরামির রাজনীতিতে ব্যস্ত, ব্যস্ত দুর্নীতিতে।
তাহলে কি হিরো আলম বুঝতে পেরেছে যে সে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কোনোদিনই ভালো কিছু করতে পারবে না? বরং নিজের একান্ত চিন্তা-চেতনাকে ভালো থেকে আরও ভালো করার চেষ্টা করছে, যা অন্যের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে।
বিজ্ঞাপন
যাই হোক, আমি আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করি, ডিবেট করি। গতকাল ছিল তেমন একটি সময় এবং সেটা ছিল এমন— আমি বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে পুঁথিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব একটা দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি, যেমনটি বড় ভাই করেছেন। তবে একটি নির্দিষ্ট কাজে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের যতটুকু দরকার ততটুকু করেছি— এটা সত্য। যেমন- ফাইজারের সব ডিরেক্টররা কমপক্ষে একজিকিউটিভ এমবিএ, পিএইচডি বা অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। আমাকেও সেই কারণে কিছু শিক্ষা নিতে হয়েছে নেহায়েত দায়িত্ব পালন করার জন্য। শিক্ষিত হওয়ার জন্য নয়
শিক্ষিত হতে যে গুণগুলো দরকার তা অর্জন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কারণ পুঁথিগত বা একটি বিশেষ কাজের জন্য যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে তারাই শুধু সমাজে শিক্ষিত নয়। স্বশিক্ষায় যারা শিক্ষিত তারাই সমাজে সুশিক্ষিত। আমি মোটামুটি সমাজের সব ধরনের কাজই করতে পারি, তবে প্লেন চালাতে পারি না। কিন্তু গাড়ি চালাতে পারি, কারণ প্লেন চালানো একটি পেশাভিত্তিক কাজ।
সমাজের হাজারো পেশাদার মানুষ অমানুষের মতো আচরণ করছে। যদিও রয়েছে ধামাধরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। আবার একই সমাজে কোটি কোটি লোক রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই। তারা সমাজের অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করছে। স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে সুন্দর জীবনযাপন করছে। যারা আমার মতো সব কাজই করে, হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক ডিপ্লোমা নেই কিন্তু সমাজের অনেক কাজ প্রতিনিয়ত করে চলছে। তাদেরকে আমরা অশিক্ষিত বলতে পারি না।
সবকিছুর পরও আমার প্রশ্ন, শিক্ষিত বলতে আমরা কি বোঝাতে চাইছি? কে শিক্ষিত এবং কেন শিক্ষিত? কে অশিক্ষিত এবং কেন অশিক্ষিত? এমনও তো হতে পারে, পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজের অশিক্ষিত! প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে অনেকে বর্জন করেছে মনুষ্যত্বকে, আবার অনেকে সামাজিক, প্রকৃতির বা পারিবারিক শিক্ষা থেকে শিক্ষিত হয়ে সুন্দর, সহজ সরল জীবন যাপন করছে। আমার এবং আমার বড় ভাইয়ের মতে, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার যেমন দরকার রয়েছে সমাজে ঠিক তেমনি টেবিল টকেরও দরকার রয়েছে। এটা ভুলে শুধু এককেন্দ্রিক হলে যেমন মানবতা এবং নৈতিকতার অবক্ষয় হবে, হবে মানুষ জাতির মধ্যে শ্রেণিবিভক্তি। যার ফলে মানুষ জাতি ভারসাম্যতার অভাবে ভুগবে আর ধুকে ধুকে যন্ত্রণায় বিছানা ধরবে এবং শেষে এপার ছেড়ে ওপারে যাবে।
ডিজিটালের যুগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চলছে প্রতিস্থাপন মানুষের সঙ্গে মেশিন এবং রোবটের, যা আমাদের কর্মের দায়িত্ব নিতে চলেছে। আবেগপ্রবণ ও মানসিক অনুভূতির ক্ষেত্রে পারবে কি ডিজিটাল গ্রহণ করতে এত বড় দায়িত্ব? আমার জানা নেই! বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে নানা জাতির ধর্ম এবং বিশ্বাসের ওপর আলোচনা দিতে পারে নৈতিকতা এবং মনুষ্যত্বের ওপর নাড়া যা করতে পারে মূল্যবোধের পরিবর্তন! তবে যে বা যারা এ যুগের কঠিন এবং অমানবিক ব্যারিকেড ভাঙবে সে হবে জয়ী। তার জন্য দরকার সাহস, দৃঢ়তা এবং উন্মাদনা। যার মধ্যে এই তিনটি জিনিস আছে তাকে ঠেকানো যাবে না। হিরো আলম কি শেষ পর্যন্ত পারবে সেটা প্রমাণ করে দেখাতে? পারবে কি নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে যে পৃথিবীতে আমরা স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীবের দেখা পাব?
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

