শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ক্যালিগ্রাফিতে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন তাওহীদের

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ক্যালিগ্রাফিতে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন তাওহীদের

রং-তুলির ক্যানভাসে নিজের স্বত্বাকে প্রকাশ করাই ক্যালিগ্রাফি। দিন দিন কদর বাড়ছে এর। মানুষ তার সৌখিন ও আভিজাত্য প্রকাশ করতে বাসার দেয়ালে দেয়ালে টাঙাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ক্যালিগ্রাফি।

ক্যালিগ্রাফির চাহিদা আমাদের দেশেও কম নয়। দেশে যে সব ক্যালিগ্রাফি শিল্পী রং-তুলিতে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে তাওহীদ সাজু অন্যতম। তাওহীদের শুরুটা হয় শখ থেকেই। ছোটবেলা থেকে আঁকা-আকি করার একটা অভ্যাস ছিল। কিন্তু কখনো ভাবেননি এই শখ তাকে এনে দেবে তার জীবনের সাফল্য।


বিজ্ঞাপন


অবশ্য, এর জন্য তাওহীদকে অনেক কষ্টের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে সব কষ্ট পেরিয়ে আজ তিনি একজন সফল ক্যালিগ্রাফার। শুধু তাই নয়, তাওহীদ একজন সফল উদ্যোক্তাও বটে। ক্যালিগ্রাফির শিল্পকে যাতে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন এর জন্য চালু করেছেন ‘কোট নোট আর্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে শত শত ছেলে-মেয়ে ক্যালিগ্রাফির শিক্ষা নিয়ে থাকে।

Caligraphy

তাওহীদ সাজু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) থেকে লোক প্রশাসন বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে কী করবেন, তা ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। এরমধ্যে কিছুদিন বেকার থাকার পর একটি বায়িং হাউজে চাকরিও নিয়েছিলন। তবে ধরাবাঁধা নিয়মে বেশিদিন নিজেকে আটকা রাখতে পারেননি নিজেকে। তাওহীদের স্বপ্নগুলো যেন ক্যালিগ্রাফির ভাঁজে ভাঁজে হাতছানি দিচ্ছিল। তাইতো চাকরি ছেড়ে ক্যালিগ্রাফির ভালোবাসায় নিজেকে মেলে ধরেন তিনি।

বড় কোনো পদে সরকারি আমলা হওয়ার স্বপ্ন না থাকলেও তাওহীদ বিশ্বমানের একজন ক্যালিগ্রাফার হওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলেন হৃদয়ে। তাই, দৃঢ় মনোবলে চোখ ধাঁধানো সব ক্যালিগ্রাফি আঁকতে পারেন তিনি। যার স্বীকৃতিস্বরুপ অসংখ্য সম্মাননাও পেয়েছেন। এছাড়া তিনটি আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেও পেয়েছেন সম্মাননা। ইতোমধ্যে তার আঁকা ক্যালিগ্রাফি দেশের সীমানা পেড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও স্থান করে নিয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরব সফরে গিয়ে কা’বা ঘরের গিলাফের প্রধান ক্যালিগ্রাফার মুখতার আহমাদ শিকদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তাওহীদ সাজু।


বিজ্ঞাপন


চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করা তাওহীদ বেড়ে উঠেন সেখানেই। ছেলেবেলায় গ্রামের মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষাজীবনের শুরু করেন তাওহীদ। পরে ২০০৯ সালে দামুড়হুদা ডিএস দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল এবং ২০১১ সালে খুলনার দারুল কুরআন সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা থেকে আলিম পাস করেন। এরপর ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে। সেখান থেকেই বিএসএস (স্নাতক) ও এমএসএস (স্নাতকোত্তর) ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষ করে তাওহীদে স্বপ্ন এখন পৃথিবীর সেরা ক্যালিগ্রাফার হওয়ার। যার জন্য করছেন প্রচুর পরিশ্রমও।

Caligraphy

নিজের পথচলা শুরুর কথা জানাতে গিয়ে তাওহীদ বলেন, ‘ছোটবেলার ভালোলাগা থেকে করা আঁকি-বুকিই যে আজ পেশায় পরিণত হবে, তা নিজেও ভাবিনি। মাস্টার্স শেষ করে একটা করপোরেট হাউজে চাকরি নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে মন টানলো না। ভাবছিলাম কীভাবে সরকারি চাকরির পড়া শুরু করব; কীভাবে লক্ষ লক্ষ প্রতিযোগীর মধ্যে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলব। তখন জানতে পারি ক্যালিগ্রাফির কথা। যেহেতু আঁকা-আঁকির প্রতি ভালোলাগা একটা ছিলই; তাই খোঁজ-খবর নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম ক্যালিগ্রাফি কোর্সে। সেই থেকেই আমার আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা নিজের আঁকা প্রতিভাগুলোকে যখন বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনুপ্রেরণা দিত। তখন ক্যালিগ্রফির প্রতি আরও আকৃষ্ট হতো তাওহীদ। ফলে কাজ দেখে অনেকেই ক্যালিগ্রাফি ক্রয়ে আগ্রহও প্রকাশ করত। তারই ধারাবাহিকতায় অল্প অল্প করে বিক্রি শুরু হয়। পরে নিয়মিত আঁকার পাশাপাশি প্রচারণা চালান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এভাবে নিজেদের নামের ক্যালিগ্রাফি করিয়ে নিতে অর্ডার করা শুরু করেন অনেকে। চালু হয়ে যায় ব্যবসায়িকভাবে তাওহীদের পথচলা। এখন তিনি ক্যালিগ্রাফিকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে নতুন কিছু করার স্বপ্ন তাকে নাড়া দিচ্ছে বারবার। তাই তাওহীদের পুরো সময়টাজুড়ে এখন শুধুই ক্যালিগ্রাফি।

নিজের মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘কোট নোট আর্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এছাড়া ইতোমধ্যেই নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে তাওহীদ অংশগ্রহণ করেছেন ক্যালিগ্রাফি নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে। চলতি বছরই আন্তর্জাতিক কুরআন ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী এবং ইন্দো-ইরান আন্তর্জাতিক কলা ও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে তাঁর শিল্পকর্ম স্থান পায়। এর আগে গত বছরের অক্টোবরেও নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক সীরাত প্রতিযোগিতায়ও স্থান পায় তাওহীদের ক্যালিগ্রাফি।

তাওহীদ সাজু বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আর্টের প্রতি প্রবল নেশা ছিল; তবে ক্যাম্পাসে এসে কিছুটা বাস্তবে রূপ নেয়। বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আল্পনা করার সময় রং-তুলির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয়। করোনার পর বায়িং হাউজে চাকরির পাশাপাশি কিছু করার জন্যে সবসময় মন টানতো। যা একান্ত নিজের পরিচয় দেওয়ার মতো। সেই ভাবনা থেকেই ক্যালিগ্রাফির সন্ধান।’

Caligraphy
ক্যালিগ্রাফার তাওহীদ সাজু। ছবি: ঢাকা মেইল

ক্যালিগ্রাফির চাহিদা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবারের প্রিয় মানুষের নাম দিয়ে করা ক্যালিগ্রাফি সবচেয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে। এছাড়াও কোরআনের আয়াত দিয়ে অনেক নান্দনিক ক্যালিগ্রাফি করা হয়।’

এ বিষয়ে প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষক মাহবুব মুর্শিদ বলেন, ‘কাজের প্রতি তাওহীদের বেশ আগ্রহ। জানবার-শেখবার আকাঙ্ক্ষাও আছে। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা শুনেছি। আমার বিশ্বাস, সে একদিন অনেক বড় ক্যালিগ্রাফার হবে।’

ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই পৌঁছে গেছে তাওহীদের ক্যালিগ্রাফি। শুধু দেশে নয়, বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, দুবাই, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশেও স্থান করে নিয়েছে তার ক্যালিগ্রাফি। করপোরেট লাইফ ছেড়ে আরবি ক্যালিগ্রাফির মতো শিল্পকে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছেন তওহীদ। যা একটি হালাল পেশা। নিজে ক্যালিগ্রাফি করার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের মাঝেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি।

ডিএইচডি/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর