বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

স্পেনের ‘মোয়াল্লেদিন’ আন্দোলন 

আজিম বাপ্পি
প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২২, ০৩:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

স্পেনের ‘মোয়াল্লেদিন’ আন্দোলন 

মুসলিম শাসন ছিল স্পেনের ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। ৭১১ সালে দেশটিতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে সেই যুদ্ধে পরাজিত হন তৎকালীন ভিসগথিক রাজা রডরিক। যা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। অষ্টম শতকের শুরুর দিকে তৎকালীন স্পেনের ধর্মান্ধ খ্রিস্টান পাদ্রীরা শুরু করেন অভিনব ও হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টিকারী এক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের মাধ্যমেই মুসলিম বিতাড়নের প্রথম বীজটি বপন করা হয়।

দীর্ঘ এক শতাব্দির শাসনামলে স্পেন সমাজে মুসলমানরা অনেকটাই মিশে যায়। সেসময় সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, কলা ইত্যাদি শিল্পের বিভিন্ন শাখায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন উমাইয়া শাসকরা। ফলে ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে স্পেনের খ্রিস্টানরা। ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ পোষণ করে খ্রিস্টান যুবকরা তাদের নাম রাখতে শুরু করে আরবি রীতিতে। ক্রুশের বদলে আল্লাহ নাম সংবলিত লকেট গলায় ধারণ করে চলাফেরা শুরু করে। অনেকেই খ্রিস্টান ধর্মত্যাগ করে আসতে শুরু করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায়। ধীরে ধীরে স্পেনের সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু ইসলামের এই প্রসার সহ্য হয়নি খ্রিস্টান পাদ্রীদের। 


বিজ্ঞাপন


ইসলামিকরণ ঠেকাতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন স্পেনের তৎকালীন খ্রিস্টান পাদ্রীরা। সহযোগীদের নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন কর্ডোভার পাদ্রী ইউলোজিয়াস। সেই আন্দোলনের নাম দেন ‘মোয়াল্লেদিন’। অর্থাৎ মুসলিম খেদাও। মুসলিম শাসনামলেই মাঠে-ময়দানে, রাস্তা-ঘাটে এমনকি মসজিদে ঢুকে ইসলামের প্রতি অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হতো। আল্লাহ, রাসুল (স.) এবং ইসলাম সম্পর্কে চরম ঘৃণা ছড়ানো অব্যাহত থাকে। এতে শাসকরা তাদের দমনে খড়গহস্ত হন। এর সুযোগ নেন তৎকালীন খ্রিস্টান পাদ্রী ও ‘মোয়াল্লেদিন’ আন্দোলনকারীরা। ইচ্ছাকৃতভাবেই আত্মাহুতি দিতে থাকেন তাদের অনেকে। ধীরে ধীরে তাদের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয় স্পেনের খ্রিস্টানদের অন্তরে। আন্দোলনে জনসমর্থন বাড়ে। মূলত মুসলিম শাসকদের প্রতি খ্রিস্টানদের ইতিবাচক মনোভাব পাল্টে দিতে ধর্মীয়ভাবেই শুরু করা হয় এই আন্দোলন। 

২১ মে ৮২২ সাল। এই তারিখেই তৎকালীন স্পেনের রাজধানী টলেডো থেকে শাসন শুরু দ্বিতীয় আব্দুর রহমান। ছিলেন একজন সিংহ হৃদয়ের পুরুষ। কিন্তু মানব স্বভাবের কিছু সীমাবদ্ধতা তার মধ্যেও বিদ্যমান ছিল। যৌবন উত্তরকালে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে মদ-সুরা, নৃত্য, সংগীত এবং নারীর নেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই সুযোগেই খ্রিস্টানদের একটি অংশ বিদ্রোহ করে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু বেশি দীর্ঘ হয়নি আব্দুর রহমান বিরোধী আন্দোলন। ওবায়দুল্লাহর মতো কয়েকজন সাহসী সিপাহসালার খুব সহজেই দমন করেন সেই আন্দোলন। কিন্তু ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে মুসলিম শাসকদের ভিত্তিমূল। 

ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের ক্ষমতালোভী স্ত্রী সুলতানাকে নিজের দলে ভেড়ান ইউলোজিয়াস। সঙ্গে ছিলেন দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের দরবারের সংগীতজ্ঞ জিরাবকে। ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে মুসলিমবিরোধী বিভিন্ন চক্রান্ত বাস্তবায়ন করতে থাকেন পাদ্রী ইউলোজিয়াস। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের মধ্যে যুদ্ধের উৎসাহ দেখা দিলেই তাকে নিরুৎসাহিত করতেন তার স্ত্রী ও জিরাব। যুদ্ধ ঠেকাতে তারা প্রয়োগ করতেন বিভিন্ন কলা-কৌশল। কিন্তু ক্ষমতার লোভে ইউলোজিয়াসের ষড়যন্ত্রে শামিল হলেও তার ঘৃণ্য পরিকল্পনার ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারেননি সুলতানা ও জিরাব। কিন্তু ক্ষমতালাভের পর সুলতানা এবং জিরাবকেও হত্যার পরিকল্পনা ছিল ইউলোজিয়াসের। 

মূলত ফ্রান্সের তৎকালীন সম্রাট লুই দ্য পায়াসের প্ররোচনায় শুরু হয় ইউলোজিয়াসের চক্রান্ত। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের বাবা আল হাকাম সম্রাট লুইয়ের বাবা শার্লিমেনের সঙ্গে অতীতে বিভিন্ন সময় যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন। সেসময় বেশিরভাগ যুদ্ধেই পরাজিত হয়েছিলেন শার্লিমেন। ফলে স্পেনের মুসলিম শাসকদের প্রতি স্বভাবগতভাবেই চরম বিদ্বেষ ছিল লুইয়ের। 


বিজ্ঞাপন


এদিকে ইউলোজিয়াস তার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে আলভারো, ফ্লোরা এবং মেরীসহ আরও অনেক লোককে বেছে নেন সঙ্গী হিসেবে। ফ্লোরা ছিলেন মুসলিম বাবা এবং খ্রিস্টান মায়ের সন্তান। ফ্লোরার মা তাকে ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মুসলিমবিদ্বেষী করে গড়ে তোলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি মুসলিম বাবার ঘর ছাড়েন এবং মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে নিজেকে উৎসর্গ করেন। পরে ফ্লোরাকে গণ্য করা হয় খ্রিস্টিয় অংশ হিসেবে। ইউলোজিয়াস-ফ্লোরা খ্রিস্টান সমাজে নিজেদের স্বয়ং খ্রিস্ট ও মেরীর রূপে উপস্থাপন করেন।

দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর তার সন্তান মুহাম্মদ স্পেনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন তার বাবার চাইতে অনেক দৃঢ়চেতা ও ধর্মপরায়ণ। তার শাসনামলে স্পেন থেকে চূড়ান্তভাবে ‘মোয়াল্লেদিন’ আন্দোলন দমন করেন তিনি। মূলত খ্রিস্টান ধর্মান্ধ পাদ্রীরা ও সুযোগসন্ধানী খ্রিস্টান থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানরাই এই আন্দোলনে যোগ দিতেন। কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে ৮৫০ থেকে ৮৫৯ সালের মধ্যে ইউলোজিয়াস, আলভারো, ফ্লোরা ও মেরীসহ মোট ৪৮ জনকে শিরশ্ছেদ করা হয়। ফলস্বরূপ মুসলিমরা আরও ছয় শ’ বছর দৃঢ়ভাবে স্পেন শাসন করতে সক্ষম হন।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর