শিশু সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং খেলাধুলার মাধ্যমে কিশোরীদের ক্ষমতায়নের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শেষ হলো কক্সবাজারে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘অ্যানুয়াল স্পোর্টস কম্পিটিশন অ্যান্ড বিচ কার্নিভাল ২০২৫’।
ইউনিসেফ বাংলাদেশ (UNICEF Bangladesh)-এর সহযোগিতায় এবং জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত ‘স্বপ্নের সারথি- সী শোর গার্লস’ প্রকল্পের এই উৎসবটি গত ১৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারের হোটেল সিগাল প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছিল এবং ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫-এ এক বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে শেষ হয়।
বিজ্ঞাপন
উৎসবের প্রথম দিনে শিশু অধিকার ও জেন্ডার সমতা বিষয়ক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পাপেট শো এবং স্থানীয় ব্যান্ড ‘পেনোয়া’-এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, জেলা ক্রীড়া অফিসার মো. আলাউদ্দিন এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের প্রতিনিধি আনিসুর রহমান। জমকালো এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক করভি রাখসান্দ এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধিবৃন্দ।

দ্বিতীয় দিনে (১৬ ডিসেম্বর) মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জেন্ডার সুরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং শিশু সুরক্ষা বিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এদিন উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রশিক্ষণার্থীদের অংশগ্রহণে সার্ফিং প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব (Final Heat)। সার্ফিং ইন্সট্রাক্টর শিরুর তত্ত্বাবধানে কিশোরীরা তাদের ভারসাম্য ও সার্ফিং নৈপুণ্য প্রদর্শন করে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে। প্রতিযোগিতায় অসামান্য দক্ষতা দেখিয়ে বিজয়ী হন এই প্রকল্পের প্রশিক্ষণার্থী আঞ্জুমান আক্তার। এছাড়া সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক নাটক, ম্যাজিক শো এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্বিতীয় দিনের আয়োজন সম্পন্ন হয়। এদিন সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শাহীন মিয়া এবং ব্যুরো অব নন-ফরমাল এডুকেশন (BNFE)-এর সহকারী পরিচালক গুলশান আক্তার।
উৎসবের সমাপনী দিনে (১৭ ডিসেম্বর) দিনের শুরুতে 'ইয়ুথ ট্যালেন্ট শো'-এর মাধ্যমে যুব অংশগ্রহণকারীরা সংগীত, নৃত্য, কবিতা এবং কৌতুক পরিবেশন করে তাদের সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এরপর শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য 'ইনভেন্টরস পাপেট' (Inventors Puppet) দলের পরিবেশনায় একটি শিক্ষণীয় পাপেট শো অনুষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞাপন
এদিন বিকেলের অধিবেশনে ‘স্পোর্টস ফর ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক একটি বিশেষ প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে সরকারি প্রতিনিধিসহ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট-এর কর্মকর্তাবৃন্দ খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর বিকাশ, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর সার্ফিং প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন এবং সেরা যুব পারফর্মারদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় বর্ণাঢ্য সমাপনী অনুষ্ঠান। পরিশেষে স্থানীয় ও আমন্ত্রিত শিল্পীদের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তিন দিনের এই জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।"

অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ক্রীড়া পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “ ‘সী শোর গার্লস’ প্রকল্পটি মূলত প্রথাগত সামাজিক বেষ্টনী ভেঙে আমাদের কিশোরীদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। আমরা বিশ্বাস করি, শিশু সুরক্ষা এবং জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়, বরং এটি একটি সামষ্টিক দায়িত্ব। কক্সবাজারের এই কিশোরীরা আজ সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করছে, তা তাদের জীবনযুদ্ধের প্রতিটি পদক্ষেপে সাহস জোগাবে। আমরা এই ধরণের উদ্যোগের পাশে আছি, কারণ এটি কেবল খেলাধুলাই নয়, বরং একটি সচেতন ও দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ।”
ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার ফাতেমা খাইরুন্নাহার বলেন, “এই উৎসবের মূল লক্ষ্য ছিল শিশুদের সুরক্ষা এবং জেন্ডার সমতা নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা। সী শোর গার্লস প্রকল্পের মাধ্যমে এই কিশোরীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি আমাদের লক্ষ্য পূরণে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।”
জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট-এর প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন ডিপার্টমেন্ট-এর সিনিয়র ম্যানেজার ইফতিখার উল করিম বলেন, “ ‘স্বপ্নের সারথি- সী শোর গার্লস’ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল খেলাধুলার মাধ্যমে কিশোরীদের নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করা এবং তাদের জন্য একটি নিরাপদ সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। আজ তিন দিনব্যাপী এই কার্নিভাল এর সফল সমাপ্তি আমাদের সেই অঙ্গীকারকেই পুনব্যক্ত করছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই কিশোরীরাই ভবিষ্যতে জেন্ডার বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।”
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত সকল অতিথি ও অভিভাবকবৃন্দ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিটি কিশোরীর জন্য একটি নিরাপদ ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। পুরস্কার বিতরণী এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে তিন দিনব্যাপী এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এজেড

