শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

মুচি : বঞ্চনার এক নাম

তাসীন মল্লিক
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

মুচি : বঞ্চনার এক নাম

পা আবৃত করতে মধ্যযুগে পোড়ামাটির শক্ত জুতা ব্যবহার করতেন এ অঞ্চলের মানুষেরা। আবার যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও ৭ থেকে ৮ হাজার বছর আগে চামড়ার তৈরী জুতা উদ্ধার হয়েছিল আমেরিকার ওরেগন রাজ্যে। স্বভাবতই জুতার সাথে জন্ম নিয়েছে জুতা তৈরীর পেশা। পেশার নাম ‘মুচি’। সে হিসেবে এই পেশার বয়স অন্তত ৯ হাজার বছর। ৯ হাজার বছরের পৌঢ় এ পেশার সূত্রধররা এখন রয়েছেন আগের মত মলিন।

armenian shoe
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ সালে প্রাপ্ত চামড়ার জুতা

বঞ্চনার ইতিহাস

ঐতিহাসিকভাবে মুচিরা ‘নিম্নশ্রেণীর’ ও সামাজিকভাবে ‘অস্পৃশ্য’। উপমহাদেশে এই সম্প্রদায়ের সরকারি শ্রেণী পরিচয় ‘দলিত’। বৈদিক ভারতীয় সমাজের বর্ণপ্রথা অনুযায়ী মুচিরা ছিলেন চার শ্রেণীর বাইরে, উপজাতি। অস্পৃশ্য বলে সমাজ থেকে আলাদাভাবে বসবাস করতেন মুচিরা। মুচিরা আজীবনই ছিলেন ভূমিহীন। দেশে অবস্থিত অধিকাংশ মুচিপাড়াই সরকারি খাস জমির ওপর নির্মিত বলে জানা যায় Self-Help Association for Rural People through Education and Entrepreneurship (SHAREE)- এর এক গবেষণা পত্রে।

ঐতিহাসিকভাবে মুচিদের অর্থনৈতিক অবস্থানও সর্বনিম্ন স্তরে। প্রাচীনকাল থেকেই অনান্য সম্প্রদায়ের সেবা করে আসছে মুচিরা। তাদের আর্থিক বা সামাজিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে তারা দরিদ্রকে আত্মীকরণ করেই চলছেন।

অনাহারে কাটে বর্তমান


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে এই জনগোষ্ঠীর অবস্থা খুবই শোচনীয়। শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মুচিদের আয়ে তারতম্য থাকলেও কেউই তাদের পরিষেবার ন্যায্য মূল্য পায় না।

আয়ের কোন নিশ্চয়তা নেই তাদের। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা পল্টন মোড়ের একাধিক মুচির সাথে কথা বলে জানা যায়, দিনের প্রথম সেবাগ্রাহীর জন্য তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উচ্ছেদ ইত্যাদিতে বন্ধ থাকে আয়। ফলে অনাহার অথবা অর্ধাহারই তাদের দৈনিক নিয়তি।

আছে সামাজিক নিগ্রহ

পেশাগত কারণে সামাজিক বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন মুচিরা। সামাজিক প্রথাগত কারণে এখনও অনেকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার বা রাষ্ট্রীয় আইনে প্রাপ্য অধিকার পুরোপুরি ভোগ করতে পারেন না। ২০১৪ সালের আইন কমিশনের রিপোর্টেও এই বাস্তবতা উঠে এসেছিল। অস্পৃশ্যতার ট্যাবু ভাঙেনি এখনও। ‍হোটেল রেস্টুরেন্টে খেতে বসে নিগ্রহের শিকার হন তারা। সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। মুচিসহ দলিত সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণে ২০১৮ সালে ‘বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৮’নামে একটি আইনের খসড়া প্রণীত হলেও, পাশ হয়নি সমাজের দলিত শ্রেণির মানুষের অধিকার আদায়ের এ আইন।

নেই ন্যূনতম মজুরি

মুচি পেশাটির জায়গা হয়েছে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ক্যাটাগরিতে। বাংলাদেশ রবিদাস ফোরামের হিসাবে দেশে মুচি সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫ লাখ মানুষ রয়েছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে মজুরি নির্ধারণের কোন আইন না থাকায় বঞ্চিত হচ্ছেন মুচি সম্প্রদায়ের লোকরা। এদিকে পেশাটি আগাগোড়া দিমজুরি পেশা। কোন নির্দিষ্ট আয় নেই তাদের। শহরে একজন মুচির দৈনিক আয় সর্বোচ্চ ৩০০-৪০০ টাকা। গ্রামাঞ্চলে মুচিদের দিনে ২০০ টাকা উপার্জনে বেগ পোহাতে হয়।

অভাব সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার

প্রাচীন এ পেশাটিতে সরকারি রয়েছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে মুচিদের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক উন্নয়ন ঘটেছে নামে মাত্র। পেশায় লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। সমাজসেবা অধিদপ্তরের বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের ওয়েব সাইটে মাত্র ৩৪ হাজার মুচির তথ্য হালনাগাদ রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

অনুপস্থিত শিক্ষা

বেসরকারি সংস্থা SHAREE এর গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মুচি সম্প্রদায়ের মাত্র ১৫ শতাংশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা রয়েছে। ১২ শতাংশ পার করেছেন মাধ্যমিক স্তর। উচ্চ শিক্ষা অনুপস্থিত সম্পূর্ণ সম্প্রদায়ের মধ্যে ।

প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো

পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে দিন দিন মুচিদের ঐতিহ্যবাহী পেশা বদলে যাচ্ছে। পেশা বদল করে ভাগ্য পরিবর্তনের দিকেই ঝুঁকছেন মুচিদের পরবর্তী প্রজন্ম। প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় এনে ঐতিহ্যবাহী এ পেশার আধুনিকায়ন দেশের অর্থনীতিকে প্রসারিত করবে। প্রতিষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত শ্রমশক্তি উন্মোচন করবে নতুন বাজার।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর