এ যেন ঠিক রূপকথার গল্প! গল্পের শেষে ঘোড়া ছুটিয়ে সাত সমুদ্র, তেরো নদী, দত্যিদানো পেরিয়ে অবলা, ঘুমন্ত রাজকুমারীকে জয় করে রাজকুমার।
ঠিক তেমনই ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলনের নেপথ্য কাহিনীও সকলের জানা। কে আগে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছোবে, তা নিয়ে নাকি প্রতিযোগিতা চলে লাখ লাখ শুক্রাণুর।
বিজ্ঞাপন
অপেক্ষাকৃত দুর্বল শুক্রাণুরা আগেই পিছিয়ে পড়ে। একে একে বাতিল হয়ে যায় বাকিরাও। লম্বা দৌড়ের পর শেষমেশ সবাইকে পিছনে ফেলে ডিম্বাণুর বাইরের পর্দা ভেদ করে প্রবেশ করে ‘বিজয়ী’ শুক্রাণু!
দুইয়ের মিলনে তৈরি হয় নতুন প্রাণ। এতদিন ধরে প্রচলিত ধারণা ছিল এমনটাই। এবার ‘নতুন’ গবেষণায় ভেঙে গেল সেই ‘মিথ’!
এর আগেও অবশ্য বেশ কয়েকবার গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, প্রতিযোগিতায় নয়, বরং ‘যোগ্য’ শুক্রাণুকে বেছে নেয় ডিম্বাণুই।
সম্প্রতি আরও একবার সে কথা উঠে এসেছে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখিকা স্টার ভার্টনের সদ্য-প্রকাশিত বই ‘দ্য স্ট্রংগার সেক্স: হোয়াট সায়েন্স টেল্স আস অ্যাবাউট দ্য পাওয়ার অফ দ্য ফিমেল বডি’তে।
বিজ্ঞাপন
বইয়ে এটি ছাড়াও নারীদেহ সম্পর্কে আরও নানা প্রচলিত ‘ভুল’ ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ভার্টন, যা থেকে আদতে প্রমাণ হয়, একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও প্রকৃত বিজ্ঞানশিক্ষার বিস্তর অভাব রয়ে গিয়েছে জনজীবনে!
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের প্রজননের বৈশিষ্ট্য হল, ডিম্বাশয়ে একসঙ্গে একাধিক ডিম্বাণু আগে থেকেই তৈরি থাকা। ‘উজেনেসিস’ নামের এই ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়া নারীর জন্মের আগেই শুরু হয়ে যায়।
জন্মের সময় নারী শরীরে ১০ থেকে ২০ লাখ ডিম্বাণু থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে সেই সংখ্যা, কমতে থাকে ডিম্বাণুর গুণমানও। বয়ঃসন্ধিকালে তা তিন থেকে চার লক্ষে গিয়ে ঠেকে। যদিও তার বেশির ভাগ ডিম্বাণুই বাতিল হয়ে যায়।
নারীর প্রজননক্ষম বছরগুলিতে সব মিলিয়ে সাকুল্যে ৩০০ থেকে ৪০০টি ডিম্বাণু নিষেকের যোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু একবারে একটি মাত্র ডিম্বাণুই প্রস্তুত করে নারীশরীর। স্তন্যপায়ী প্রাণীর এই প্রজনন কৌশল এসেছে দফায় দফায় অভিযোজনের মাধ্যমে।
মার্কিন ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবিক নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক লিনেট সিভার্ট বলছেন, এর আগেকার পদ্ধতিটি ছিল জীবদ্দশায় একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু তৈরি করা।
এখনও মাছ, উভচর প্রাণী এবং সরীসৃপদের প্রজনন হয় সেই চিরাচরিত পদ্ধতিতেই। স্ত্রী মাছ এবং ব্যাঙেরা তাদের ডিম্বাণুর সবটাই পানিতে ফেলে দেয়। সেই ডিম্বাণুর দিকে তাদের শুক্রাণু নিক্ষেপ করে পুরুষ মাছ ও ব্যাঙেরা। ক্রমে নিষিক্ত ডিম্বাণুগুলি বিকশিত হয়।
কোনো ও কোনওটি নষ্ট হয়ে যায় প্রতিকূল পরিবেশের কারণে। কোনওটির আবার খাদ্যশৃঙ্খলের উপরের দিকে থাকা প্রাণীদের পেটে জায়গা হয়! সামুদ্রিক কচ্ছপেরা আবার যৌন মিলন করে, কিন্তু তারাও একসঙ্গে কয়েকশো নিষিক্ত ডিম পাড়ে। ওভিপেরাস সাপেরাও তাই।
এই সব প্রাণীদের জন্য প্রজনন হল সংখ্যার খেলা! অগুন্তি ডিম্বাণু, অগুন্তি শুক্রাণু, অগুন্তি নিষিক্ত ডিম এবং— অগুন্তি সন্তান!
মানুষের ক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেক শুক্রাণু উৎপাদনের এই কায়দা পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু নারী শরীর সে রকম নয়। আর সেখানেই রয়েছে আসল রহস্য।
লিনেটের কথায়, ‘মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাছের প্রজননের কায়দাই রপ্ত করেছে পুরুষেরা। তারা এখনও একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু উৎপাদন করে। অথচ তারা যে কেবল সেরা শুক্রাণুগুলিই বেছে বেছে বার করে দিচ্ছে, এমনটা কিন্তু নয়! বরং মাছের মতো কোনও বাছবিচার না করেই সব শুক্রাণু বার করে দেয় তারা।
এবার প্রশ্নটা হল, তা হলে নারীদের ক্ষেত্রে কেন সেই নিয়ম খাটে না? লিনেট বলছেন, এখানেই রয়েছে জীববিজ্ঞানের এক অমীমাংসিত প্রশ্ন, যে প্রশ্নের উত্তর মেলে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, এমন কিছু পরিবর্তন হয়েছিল, যা পৃথক করেছে দুই লিঙ্গের প্রজনন কৌশলকে।’
তবে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না মিললেও এই রহস্যের একটি সম্ভাব্য উত্তর অনুমান করে নেওয়াই যায়— নিয়ন্ত্রণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ত্রী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে নিষেক হয় তাদের দেহের অভ্যন্তরেই।
অথচ উভচর, সরীসৃপ কিংবা মাছেদের ক্ষেত্রে তা নয়। সে কারণেই এই অবশ্যম্ভাবী সংখ্যানিয়ন্ত্রণ। তবে মাছ কিংবা ব্যাঙেদের ক্ষেত্রেও যে বিপুল সংখ্যক অপত্যের সবাই বেঁচে থাকে তা নয়।
প্রতিকূল পরিবেশ, শিকারীর নজর, জলের লবণাক্ততা, দূষণের মতো নানা পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে স্থির হয়, শেষমেশ কে কে বেঁচে থাকবে আর কে মারা যাবে। স্পষ্টত, উভয় কৌশলই কার্যকর।
স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিষয়টা একই রকম। এখানে কেবল কোন অপত্য বেঁচে থাকবে আর কে থাকবে না, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গর্ভধারণের আগেই নিয়ে ফেলে নারীশরীর! ফলে স্বভাবতই কোন বিশেষ ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মিলন হবে, তা-ও স্থির হয়ে যায় নিষেকের আগেই।
আর যখন একসঙ্গে অগুন্তি অপত্যের বদলে মাত্র একটি বা দু’টি সন্তান জন্মের প্রশ্ন ওঠে, তখন এটি নিশ্চিত করাও প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে সেই সন্তানের বেঁচে থাকার সর্বোত্তম সম্ভাবনা রয়েছে কি না। সে কারণেই চলে ‘যোগ্য’ শুক্রাণু বাছাই!
-এমএমএস

