শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বাবার যত না বলা কথা

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২২, ০২:১৪ পিএম

শেয়ার করুন:

বাবার যত না বলা কথা

আমার বাবা। অজপাড়া গাঁয়ের একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। যাকে বলে সাদামাটা স্বভাবের। সবার কাছে তিনি স্বপ্নচারী। তাঁর ভাবনাগুলোও একান্তই নিজের মতো। জীবনের শিক্ষকতার প্রাক্কালে প্রতিষ্ঠা করেছেন দুটি স্কুল। মানুষকে জানানোর প্রেষণাই তাঁকে শিক্ষানুরাগী করে তুলেছিল। হয়ে উঠেন শিক্ষার আলো বিস্তারে স্বপ্নবাজ। ঘরে আমাদের দুই ভাই বোনের বাইরেও পাড়ার শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এ এক অদ্ভুত কাণ্ড বাবার- যা নিয়ে দাদি, মায়ের কথা শোনা ছিল প্রতিদিনের ঘটনা।  

বাবা দুটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন জীবনে। ৩৭ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। বাবার স্বপ্ন ছিল অনেক। নিজের জন্য তেমন কিছু করার চেষ্টা করেননি। তার চেষ্টা ছিল মানুষের জন্য কিছু করার।


বিজ্ঞাপন


দাদির বাছে শুনেছি- ছোটবেলায় বাবা বেশ সৌখিন ছিলেন। বড় বাড়ির খুব আদরের বড় সন্তান ছিলেন। কিন্তু আমার দেখা তার ঠিক বিপরীত। এক কাপড়ে কাটিয়ে দিতেন বছরের পর বছর। রোদ বৃষ্টিতে ব্যবহার করা ছাতাটা মেরামত করেছেন কতবার, কে বা জানে। বাবার সাইকেলটা ছিল বেশ পুরনো। তবে সাইকেলের বেল ক্রিং ক্রিং শব্দ ছিল বেশ।

আমরা দুই ভাইবোন পিঠাপিঠি। বাবাকে ভয় পেতাম ক্ষাণিকটা। অল্পভাষী বাবা খুব একটা বকা দিতেন না। স্বপ্ন দেখাতেন। খুব বেশি দুষ্টুমিতে কাছে নিয়ে পাড়ার স্কুলে রোল নাম্বার ১ হওয়া ছেলেটার গল্প শোনাতেন। মা মাঝেমধ্যে বাবার ওপর রাগই করতেন। একদিকে ঘরের অভাব। এ অভাব খাবারের না। কিছুটা ভালো থাকার। যা ছিল বাবার চোখে অপ্রয়োজনীয়। হয়তো তা না হলে বাবার স্কুল প্রতিষ্ঠাই হতো না।

মায়ের ভাষায়- বাবা রাজ্যর কাজ শেষে বাসায় ফিরেন। স্কুলের ক্লাস শেষেও বাবা কাজ করতেন। কেন যানি স্কুল ছুটির পর সন্ধ্যা নামতো। বাবা তখনও কাঠের মস্তবড় হেডমাস্টারের চেয়ারটাতে বসে কাজ করছেন। টানা তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বাসায় যেতেন। যার প্রমাণ মিলতো পরদিন স্কুলে আসার পর। বাবার সাথে রাতে খাবার খাওয়ার শখ তেমন পূরণ হতো না। বাসায় আসতেন দেরি করে। তবে দূর থেকে বাবার উপস্থিতি টের পেতাম, সাইলের ক্রিং ক্রিং শব্দে।  

আমাদের গ্রামের বাড়িটিকে সবাই বড় বাড়ি বলে। প্রায় একশ ফ্যামিলি থাকতো। দুটো উঠান, কাচারী ঘর, দুটো পুকুর আর জমিজমা ছিল বেশ ভালোই।


বিজ্ঞাপন


কিন্তু বাবা কখনও জমিজমার খোঁজ রাখতেন না। ধানের সিজনে অর্ধশতাধিক মানুষ কাজ করতো আমাদের বাড়িতে। কারণ যখন বিভিন্ন এলাকা থেকে ধান নিয়ে আসতো পাঁচটি কাডামি নৌকায়। তখন উৎসব লেগে যেত বাড়িতে। দুই উঠান ভর্তি ধান। আমাদের ছোটদের বেশ খুব মজাই হতো। তবে জমিজমার ব্যাপারে বাবা কখনোই কিছু বলতেন না। আমাদেরও খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

এই গল্প বাবার.. তাই, বলা। বাবা পড়াশোনার পাশাপাশি সিনেমা দেখতেন, ঘুরতেন। দাদা যখন আমার মাকে বাড়ি নিয়ে এলেন, প্রথম কথাটি ছিল, ওর হাতে যত টাকা দিবা, সব খরচ করে আসবে, মা তুমি ওর সংসারটা লক্ষ্মী হয়ে আগলে রেখো।

বাবা চিরদিনই আমাদের মতো বেহিসেবি ছিলেন। তাই মাঝে মধ্যেই অভাবে পড়তে হয়েছে আমাদের।

বাবা দুটো হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। একটি গ্রামে ও একটি জেলা শহরে। শহরের মধ্যে বেড়ে ওঠা একটি পরিত্যক্ত জঙ্গল পরিষ্কার করে সামান্য কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু করেন। তাই ফাইভ পর্যন্ত ছেলেরা পড়ে এখনও। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে ৩৭ বছর ছিলেন সুনামের সাথেই।

বাবা ঢাকাতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে, সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে মানবতার সেবায় নেমে ছিলেন। কারণ তার সব স্বপ্ন স্কুল ঘিরেই ছিল। গত বছর নিজ জেলায় গিয়ে দেখলাম, স্কুল গেটের সাইনবোর্ড থেকে বাবার নামফলকটি মুছে দিয়েছে কতিপয় নেতা। দাঁড়িয়ে ভাবছি- বাবার কতই না ছিল না বলা কথা।

বাবার সঞ্চয় বলতে আর ছিলাম আমরাই। তার যোগ্য হয়ে উঠতে চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। চেষ্টা করছি মানুষ হতে। বাবা, ক্ষমা করো আমায়।

ডিএইচডি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর