শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সুবার্তার দিন

হাসান শাওন
প্রকাশিত: ১৫ মে ২০২২, ১২:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

সুবার্তার দিন
ইলাস্ট্রেশন ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

তখন রোদ তীব্র। তখন অফিস টাইম। তখন সকাল ৮টা। তখন মিরপুর নম্বর ১ বাসস্ট্যান্ডে ব্যস্ততা।

থেমে নেই হকারদের কলরব।

আক্কাস টেম্পুর ড্রাইভিং সিটে। কানে ম্যাচের কাঠি। স্পিকারে গান বাজছে।

‘গাবতলীতে গাড়ি থুইয়্যা, কেন গেছিলি চাঁনখারপুল?
জীবনে এই করিলি ভুল মনা, এই করিলি ভুল . . .’

আক্কাসের ডান হাত স্টিয়ারিংয়ে। পরণে লুঙ্গি। বাম হাতে এইমাত্র অণ্ডকোষ চুলকালো। মুখে মাস্ক নেই। পিচ করে থুথু ফেললো বাইরে। থুথুর বেশিটা পড়লো সামনের আধভাঙা ব্যাক মিরর ভিউয়ে। বিরক্তি তার চরমে। ওর পায়ের রানের ওপর রাখা ময়লা গামছা। সেটা দিয়ে গ্লাসের থুথু মুছে ফেলে। গান বন্ধ করলো। মুখ দিয়ে বের হলো-

: ‘হালার পেসেঞ্জারডি গ্যালো কৈ?’

৯ বছরের হেলপার রইছকে বলল,

: ‘.  . . পোলা ডাকোছ না ক্যা? আগের গাড়ি লোড।’

রইছ থেমে ছিল না। সে বারবার ডাকছিলো, ঐ মোহাম্মদপুর, মোহাম্মদপুর. . .। আক্কাসের গালিসমেত কথার উত্তর দেয় না ও। টেম্পুর গায়ে ‘থামুন’ লেখা জায়গাটায় সশব্দে থাপ্পড়াচ্ছিলো রইছ। টেম্পুর নাম ‘রহমত পরিবহন’। কিছু বর্ণ ওঠে গেছে। এখন শুধু দেখা যায় , ‘মত পরি’
 
তিতিরের বয়স ২১। ও টেম্পুতে ওঠে প্রথমে। গন্তব্য শ্যামলী।


রইছ থেমে ছিল না। সে বারবার ডাকছিলো, ঐ মোহাম্মদপুর, মোহাম্মদপুর. . .। আক্কাসের গালিসমেত কথার উত্তর দেয় না ও। টেম্পুর গায়ে ‘থামুন’ লেখা জায়গাটায় সশব্দে থাপ্পড়াচ্ছিলো রইছ। টেম্পুর নাম ‘রহমত পরিবহন’। কিছু বর্ণ ওঠে গেছে। এখন শুধু দেখা যায় , ‘মত পরি’

টেম্পুর সিটে একে একে যাত্রী ওঠেন। তাদের মধ্যে আছেন বোরকা পরিহিতা মেয়ে শিশুসহ এক মা। শিশুর মুখে মাস্ক। হাতে ব্যাগ। তাতে সুপারম্যানের স্টিকার। হাতে শাঁখা পরিহিতা এক নারী। টেম্পুতে আরও আছেন স্যুট টাই পরিহিত যুবক। তার মুখে মাস্ক। একজন রাজমিস্ত্রি। তার টুকরি নিয়ে। তার মুখে মাস্ক নেই। টেম্পুর ভেতরে স্টিকার। ‘যৌন দূর্বলতায় যোগাযোগ কলিকাতা হারবাল . . .’। আরেকটি স্টিকার ‘পবিত্র ওরশ মাহফিল’। একে একে সব সিট পূর্ণ হয় যানের। পাদানিতেও হেলপার রইছের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দু’জন। এরপরও গাড়ি ছাড়ে না।

তখন এক যাত্রীর মন্তব্য:

: ‘ঐ । ছাদেও লোক নিবিনি তুই?’

রইছের উত্তর:

‘চাইপ্যা বহেন।
ওস্তাদ, চালু দেন। বামে পেলাস্টিক দেইখ্যা . . .’

যাত্রীদের একজন দৈনিক পত্রিকা বের করেন। বিনোদন পাতায় বড় ছবিসহ নিউজ।
‘নতুনভাবে ফিরছেন সানি লিওন’। সব পুরুষ যাত্রীর চোখ তখন সানি লিওনের ছবির দিকে।

পাইকপাড়ায় টেম্পুর ছাদে থাপ্পড় রইছের। গাড়ি থামে। সানি লিওন থেকে হুশ ফেরে অনেকের।

: ‘ওস্তাদ, বাইমে চাপান। নামবো একজন।’

টেম্পুর পাদানিতে থাকা একজন নামেন।  

বাংলা কলেজের একটু আগে অপজিটে র‌্যাবের একটি গাড়ি তীব্র সাইরেন দিয়ে টেম্পুকে পাশ কাটায়। তখন লেগুনার সুপারম্যান লেখা ব্যাগটি হাত থেকে পড়ে যায় শিশুর। তাকে কোলে নেয়া মা ব্যাগটি ওঠিয়ে আবার শিশুর হাতে দেয়। কেউ কোনও কথা বলেন না।

কলেজের সামনে আবার রইছের থাপ্পড়। গাড়ি থামে।

:‘ওস্তাদ, ইসটুডেন নামবো।’  

টেম্পুর পাদানি থেকে আরও একজন নামে।

dhaka
বেশিরভাগ যাত্রী টেকনিক্যাল মোড়ে নামলেন। তাদের গন্তব্য গাবতলী।  এরপর টেম্পুতে যাত্রী তিনজন।

তিতিরের এক হাতে মায়ের জন্য আনা ঘরে পড়ার শাড়ির ব্যাগ। অন্য হাতে টাকার পার্স।
এত প্যাসেঞ্জার নামায় আক্কাস আর রইছের উদ্বেগ। সামনের সিট থেকে আবার আক্কাসের চিৎকার।

: ‘প্যাসেঞ্জার উডাস না ক্যা...?(গালি)

উত্তর দেয় রইছ।

: ‘ওস্তাদ এডি গাবতলী যাইবো। এই দিককার না।’

ড্রাইভার থামে না। বলে, ‘তুই ডাক।’

শুরু হয় ছাদে থাপ্পড়। সঙ্গে ডাক, ‘ঐ মোহাম্মদপুর . .মোহাম্মদপুর. . .।’  

আক্কাস বলতে থাকে,

: ‘আমিও বাড়ি যামু। রাইত দশটায় গাবতলী আমু। ৮ টা পর্যন্ত গাড়ি চালামু। ট্যাকাটুকো মহাজনরে দিমু। আল্লাহ’র নামে রওনা দিমু। গাড়ি পাই আর না পাই। তুই প্যাসেঞ্জার ওডা। আইজ টাইম নাই।’

বাংলা কলেজের একটু আগে অপজিটে র‌্যাবের একটি গাড়ি তীব্র সাইরেন দিয়ে টেম্পুকে পাশ কাটায়। তখন লেগুনার সুপারম্যান লেখা ব্যাগটি হাত থেকে পড়ে যায় শিশুর। তাকে কোলে নেয়া মা ব্যাগটি ওঠিয়ে আবার শিশুর হাতে দেয়। কেউ কোনও কথা বলেন না।

এই টেকনিক্যালেই তিতিরের ১০০ টাকার নোট নিয়ে বচসা শুরু। মাত্রই ওস্তাদের ঝাড়ি খাওয়া হেলপার রইছ বলে, ‘এই ট্যাকা ক্যামনে চালামু। উডেন ক্যা এমুন নোট নিয়া।’


বিজ্ঞাপন


তিতিরের পার্সে আর কোনও টাকা নেই। ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে তার কাছে থাকবে আর ৮০ টাকা। মায়ের ভাগ্য জেনে এরপর ফিরতে হবে তা দিয়েই। ওর তাড়া মায়ের কাছে যাওয়ার। এ সময় তিতির বলে,

: ‘ভাই, আপনি পুরো ১০০ টাকাই রাখুন। ৮০ টাকা ফেরত দিতে হবে না।’ রইছ তখনও ফুঁসছে।
: ‘আপনের টেপ মারা ট্যাকা রাইখ্যা কি করুম?’
টেম্পু চলতে থাকে। দারুস সালাম, কল্যাণপুর পাড় হয়। নোট নিয়ে ঝামেলা মেটেনি তখনও। কল্যাণপুরের একটু আগে বেশ কিছু যাত্রী মেলে। গাড়ি ভরে যায়। এখন টেম্পু শ্যামলীর কাছাকাছি। কিন্তু তিতিরের সাথে রইছের মীমাংসা হয় না।

dhaka

রাজমিস্ত্রি বলে ওঠেন,

: একটু টেপে সমস্যা কী? ভাড়া রাখ।

তিতির বলে,

: ভাই, এটিএম থেকে তোলা টাকা। টেপ মারা আগে দেখিনি। আমার কী দোষ?

এ পর্যন্ত আক্কাস এ নিয়ে কথা বলেনি। এবার সে বলে,
: ‘ঐ, আপা কৈ নামবো?’
রইছের উত্তর।
:‘ সামনেই। শ্যামলীত।’
আক্কাস বলে,
: ভাড়া লাগবো না। আপারে নামা।
তিতির নামে।
ড্রাইভিং সিটের সামনে গিয়ে আক্কাসের সামনে দাঁড়ায়। মুখের মাস্ক নামায়।
: ‘ভাই, আপনাকে আবার কিভাবে পাবো? ভাড়ার টাকা তো আমি দিতে চাই।’
আক্কাস উত্তর দেয়।
: ‘যাইবেন কৈ? হাসপাতাল? আপনের মা ভর্তি? করোনা? যান আপা। খালাম্মার লাইগ্যা দোয়া করি। হেরেও দোয়া করতে কইয়েন। আল্লাহ ভরসা।’
তিতির ঘাম মেছে, হাসে। সব কথার উত্তর হয় না। হাঁটা দেয়। হেলপার রইছ তখন পেছন থেকে ডাকে।

: ‘আপা, শাড়ির ব্যাগ আপনের না? নিয়া যান।’ নোটের হুজ্জতে ভুলে গেছিল তিতির শাড়ির ব্যাগটার কথা। রইছ নিজেই ব্যাগটা হাতে দেয়। আবার কিছু কিছু নতুন যাত্রী ওঠে টেম্পুতে। রইছের মেজাজ ভালো আগের চেয়ে।

dhaka

তিতির রাস্তা পাড় হয়। হাসপাতালের নিচে পৌঁছে দেখে ওর বড় ভাই। তার মুখের মাস্ক নামানো। একমাত্র ভাতিজা রাইয়ানকে কোলে নিয়ে বাপ বেটা চকবার খাচ্ছে। দু’জনের মুখে আইসক্রিম লেগে একাকার।

তিতির রাস্তা পাড় হয়। হাসপাতালের নিচে পৌঁছে দেখে ওর বড় ভাই। তার মুখের মাস্ক নামানো। একমাত্র ভাতিজা রাইয়ানকে কোলে নিয়ে বাপ বেটা চকবার খাচ্ছে। দু’জনের মুখে আইসক্রিম লেগে একাকার।

তিতির রাইয়ানকে কোলে নেয়ার জন্য হাত বাড়ায়। প্রশ্ন করে না। ভাইয়া বলে, ‘তুই এত ঘামছিস কেন? আম্মা নেগেটিভ। একটু আগে ডাক্তার বললো।’

তিতির মাথার স্কার্ফ ঠিক করে। মাস্ক নামিয়ে আবার মুখের ঘাম মেছে। হাত স্যানিটাইজ করে। রাইয়ানকে কোলে নিয়ে বলে,

: ‘দে। আমিও খাবো।’

পাঁচ বয়সী রাইয়ান উত্তর দেয়।

: ‘ না . . .তোমাতা অন্য।’

ভাইয়া তিতিরের হাতে তুলে দেয় কাপ আইসক্রিম। বলে,

: ‘তুই তো চকবার পছন্দ করিস না।’

আইসক্রিম খেতে খেতে ৩ জন হাসপাতালের রিসেপশনের দিকে আগায়।

লেখক পরিচিতি

লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।

২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে” প্রকাশিত হয়।

এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর