বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪, ঢাকা

বিজয় সরণি: সড়ক মোহনায় বেশি অপেক্ষা

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

বিজয় সরণি: সড়ক মোহনায় বেশি অপেক্ষা
বিজয় সরণি মোড়ে লেগেই থাকে যানজট। ছবি: ঢাকা মেইল

খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট পুলিশ বক্সের পাশ দিয়ে বিজয় সরণি মোড়। দূরত্বের হিসেবে এক কিলোমিটার, যা সাধারণত ছুটির দিনে বা ফাঁকা সড়কে মোটরবাইকে সময় লাগে দুই থেকে তিন মিনিট। স্বাভাবিক যানজটের সময় লাগে ৮-১০ মিনিট। সেই এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে এখন সময় লাগছে কমপক্ষে ২০ মিনিট।

রমজানে রাজধানীজুড়ে দেখা দিয়েছে অসহনীয় যানজট। ট্রাফিক বিভাগ বলছে, এটি শুধু রোজার কারণে নয়, করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় রাস্তায় আগের চেয়ে মানুষ ও গাড়ি উভয়টিই বেড়েছে।


বিজ্ঞাপন


তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) এসএম শামীম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রমজানে যানজট বেড়েছে এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে যে বিধিনিষেধ ছিল তা শিথিল হয়েছে, সব খুলেছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত খুলেছে। যে গাড়িগুলো এর আগে বাসা বা অফিসে ছিল সব এখন বাইরে বেরিয়েছে। দেশে গত দুই বছরে তিন লাখ ৬৫ হাজার গাড়ি বেড়েছে। যা গত দুই বছর রাস্তায় দেখিনি। করোনার মধ্যেও মানুষ প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চারশ গাড়ি কিনেছে। এই গাড়িগুলোও রাস্তায় নেমেছে। ফলে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া ডিপিডিসি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং মেট্টোরেলের কাজের জন্য রাস্তার ৩০-৪০ শতাংশ জায়গা কমেছে। জনসংখ্যাও বেড়েছে।’

শামীম আরও বলেন, ‘এটার স্বস্তি আমরা পেতে পারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং মেট্রোরেলের কাজ শেষ হওয়ার পরে। তার আগ পর্যন্ত এই যন্ত্রণা বহন করতে হবে ঢাকাবাসীকে।’

সকালের ৯টার পর যানজট বাড়তে থাকে। দুপুরের দিকে একটু কমে। আবার ২টার পর থেকে শুরু হয় তীব্র জট। যা গড়ায় ইফতার পর্যন্ত। ইফতারের পর থেকে আবার ফাঁকা হয়ে যায় রাজধানী।

এই প্রতিবেদক সকাল ১০টায় খামারবাড়ি থেকে মোটরবাইকে বিজয় সরণি পৌঁছায় ২২ মিনিটে। হেঁটে এলে আরও কম সময়ে আসা সম্ভব।


বিজ্ঞাপন


দীর্ঘ সময় একটি মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সিএনজি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করছিলেন চালক বোরহান। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‌'জীবনটা শেষ হইয়া যায়। ফার্মগেট থেকে ভাড়া নিয়ে পাঁচ মিনিটের সড়কে ৩০ মিনিট অপেক্ষায় আছি। ভাড়া মাইরা কেমনে পোষামো। আবার মালিকরে দেওয়া লাগে, গ্যাস খরচ। পোষায় না গো ভাই।'

গণপরিবহনে যারা যাতায়াত করেন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কেউ কেউ হেঁটে যাত্রা শুরু করেন। তবে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় মোটরবাইক চালকদের। কেননা বাইক রেখে যেতেও পারেন না, আবার কড়া রোদে রোজায় দীর্ঘ অপেক্ষায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।

বিজয় সরণি, ঢাকা শহরের একটি প্রধান ও ব্যস্ত সড়ক। ফার্মগেট থেকে পুরাতন বিমানবন্দরের মাঝামাঝি সনি র‌্যাংগস ভবন থেকে খামার বাড়ি হয়ে রোকেয়া সরণিকে আড়াআড়ি সংযুক্ত করেছে। যাওয়া-আসা মিলে আটটি সড়ক এখানে। যার এক পাশে গাড়ি ছাড়লে বন্ধ হয় বাকিগুলো। ফলে গাড়ির পেছনে গাড়ি এসে লম্বা হয় সারি। এখানে মহাখালী থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিজয় সরণি হয়ে ফার্মগেটে আসার একটি মাত্র রাস্তা। সাতরাস্তা বা মহাখালী থেকে ফ্লাইওভায় হয়ে বিজয় সরণি আসার রাস্তা, সংসদ ভবন থেকে বিজয় সরণি আসার রাস্তা এবং ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণি আসার রাস্তা মিলে চার রাস্তার সংযোগে আসা-যাওয়ার রাস্তা মিলে আট রাস্তা এখানে।

jam2

দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে দেখা যায়, সংসদের সামনে হয়ে আসা গাড়িগুলো ট্রাফিক পুলিশ যাওয়ার জন্য সিগন্যাল দিলে অন্য প্রান্তে তখন থেমে আছে গাড়ি। ফার্মগেট থেকে আসা গাড়িগুলোর তখন জট লেগে যায়। ১৫, ২০, ৩০ মিনিট বা আরও বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় যাতায়াতকারীদের। একই সময় দেখা যায় সংসদের দিক থেকে আসার উল্টা পাশে যানজট লেগে ফ্লাইওভারের ওপরে উঠে গেছে। অন্যপাশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পেরিয়ে সেই জট ছড়াতে থাকে জাহাঙ্গীর গেটের মোড় পর্যন্ত। জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা গাড়িগুলো যখন চলছিল তখন অন্যপাশে থেমে আছে গাড়ি। সংসদের মোড় পর্যন্ত চলে যায় সেই জটলা।

দুপুরের পর ইফতারের আগে তীব্র জট দেখা যায়। দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশকেও হিমশিম খেতে দেখা যায়।

তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করেন ট্রাফিক পুলিশ

জানা গেছে, তিন শিফটে এখানে ট্রাফিক সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। এরমধ্যে সকালে শুরু হওয়া শিফট চলে আড়াইটা পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় আরেক টিমের দায়িত্ব, যা চলে ১০টা পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় রাতের টিমের দায়িত্ব। দিনের শিফটে একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর, দুজন সার্জেন্ট এবং ছয়জন ট্রাফিক কনস্টেবল সবসময়ই সড়ক যানজটমুক্ত রাখতে কাজ করে যান। যার তদারকি করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বিজয় সরণিতে দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. সুজা উদৌলা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যানজট বেড়েছে এটা বলবো না। কেননা বিগত বছরেতো বিধিনিষেধের কারণে সবাই ঘর থেকে বের হয়নি। রোজায় দিনে মুভমেন্ট থাকে, ফলে চাপ থাকে। সবার ইফতারের আগে ফেরার তাড়া থাকে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি, মানুষকে নির্দিষ্ট সময়েই যাতে ঘরে ফিরতে পারে।’ 

বিজয় সরণিতে আটকে থাকা বাসচালক জসিম উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাজধানীর প্রতিটি সিগন্যালে যদি কমপক্ষে ১০ মিনিট করে থামতে হয় তাহলেও এক ঘণ্টা।’ তিনি হিসাবে করে বলেন, ‌'ধরেন ফার্মগেট থেকে মহাখালী যাবো। পথে ফার্মগেট পুলিশ বক্স, বিজয় সরণি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী রেলগেটে ৫০ মিনিট যানজটেই শেষ। ঢাকার সব জায়গায় সিগন্যাল মানেই সেখানে ১০ মিনিট লাগবো, ধইরা নেন।’

পুলিশ সদস্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন উল্লেখ করে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এসএম শামীম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন পুলিশ ঠিকমতো কাজ করছে না। ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগ যেভাবে কাজ করছে আমি নিজেও অবাক হই। পুলিশ সদস্যদের জন্য যানজট মোকাবিলা, এটি খুবই চ্যালেঞ্জিং। পুলিশ সদস্যরা ভোর থেকে রাত সবসময় আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন কীভাবে ঢাকাবাসীকে ইফতারের আগে বাসায় পৌঁছানো যায়। নিজে ইফতার না করে, নিজে সেহরি ঠিকমতো না খেয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন ঢাকাবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য। আমাদের প্রত্যেক সদস্য ডিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশনায় কাজ করে যাচ্ছেন।’

jam3

রোজায় দিনের বেলায়ই মানুষের চলাফেরা একটু বেশি হয়, এটি যানজটের একটি কারণ নাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা প্রধান কারণ, এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রোজায় মানুষ রাতের চেয়ে দিনের বেলা বেশি মুভমেন্ট করেন। আর স্কুল কলেজ খোলাতো অবশ্যই একটি কারণ।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রমজান মাসে মানুষের একটি তাগিদ থাকে ইফতারটা বাসায় গিয়ে করতে। যখন রমজান মাস না থাকে তখন হয়তো ৮টা ৯টায় ফিরে। আবার অফিস সূচিতেও পরিবর্তন আসে। ইফতারের আগে বাসায় ফেরার তাড়া থেকেই রমজানে ইফতারের আগে যানজট বাড়ে, যেটি অন্য মাসে সন্ধ্যার সময় হয় না। তবে আবার ইফতারের পর দেখবেন রাস্তা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কেননা সবাই কাজ সেরে বাসায় ফিরে যায়। তবে ১৫ বা ২০ রোজার পর থেকে কিন্তু ইফতারের পরও জট বাড়বে। কারণ ওই সময় আবার মানুষ ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটা করতে বের হবেন।’

প্রতিনিয়তই সড়কে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। আবার সরকারের উন্নয়ন কাজের কারণে সড়কও ছোট হয়ে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে দেশে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যানবাহন ছিল ১৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৬৮টি। এক যুগ পর সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টিতে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দেশের সড়কে গাড়ি বেড়েছে প্রায় এক লাখের মতো। দেশের সড়কে প্রতিদিন গড়ে নতুন প্রাইভেটকার নামছে ৫০টি। মোটরসাইকেল বাড়ছে ১৪০৯টি করে।

বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুরুর দুই মাসে মাসে দেশে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে ৯৬ হাজার ৮৭৮টি গাড়ির। অন্যান্য গাড়িও আছে। সড়কে গাড়ি বাড়ছে, জটও বাড়ছে।

ডব্লিউএইচ/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর