মোনতাহেনা পিংকি যখন কাঁদো কাঁদো গলায় স্বামীর সন্ধান চেয়ে আকুতি জানাচ্ছেন সংবাদ সম্মেলনে, সাড়ে চার বছরের মেয়ে জালসান তখন টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে বাবার ছবি দেখছে। তার বিশ্বাস ’বাবা ফিরে আসবেন।’ কারণ বাবা কখনোই এতদিন তাদের ছেড়ে থাকেননি। অবুঝ সন্তান যখন বাবার খোঁজ জানতে চায়, মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল পিংকির। আকুতি তার, যে করেই হোক সাক্ষাৎ চান প্রধানমন্ত্রীর।
আজ সোমবার (৪ এপ্রিল) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরম খাঁ হলে সংবাদ সম্মেলনে মাছ ব্যবসায়ী ইমাম মেহেদী হাসান ডলারের সন্ধান চাওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
এর আগে ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মেহেদী হাসান ডলারের সন্ধান চেয়ে পরিবারের পক্ষ হতে সংবাদ সম্মেলন করে তার পরিবার। এর আগে গত বছরের ১৭ নভেম্বর ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা।
পিংকি বলেন, ‘আমি দুইটা বাচ্চাকে (এক মেয়ে ও এক ছেলে) নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার এ বার্তাটুকু প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেন। সন্তানগুলি সর্বত্র তাদের বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গত পাঁচ মাস অনেক চেষ্টা করেছি, অনেকের কাছে ধরণা দিয়েছি। জিডি করেছি। র্যাবের কাছে গিয়েছি। কোথাও সন্ধান পাইনি।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে পিংকি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। আমার স্বামী গত ৬ নভেম্বর ফুলবাড়িয়া উপজেলার ছনকান্দা বটতলা এলাকায় নিজের ফিশারি প্রজেক্ট থেকে বাড়ি ফেরার সময় নিখোঁজ হন। বিকাল ৫টায় একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস এবং দুটি মোটরসাইকেলে একদল লোক তাকে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ খবর নিয়ে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি। আমরা অনেক খোঁজখবর করেও পাইনি। এর ঠিক দুই দিন পর তার মোবাইল অনলাইনে শো করে। তখন তার লোকেশন শো করে ঢাকা উত্তরার র্যাব হেড কোয়াটার্সের কাছাকাছি। আমার ধারণা, প্রশাসনের লোকজন ওনাকে তুলে নিয়েছেন। যদি ওনি কোনো অপরাধ করে থাকেন, ওনাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসুন। ওনাকে গুম করে রেখে আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন কেন? আমার শশুর-শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওনি বেঁচে আছেন, নামি মরে গেছেন তাও জানি না।’

বিজ্ঞাপন
পিংকি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাতে চাই--তিনি যেন আমার সন্তানদের বাবাকে ফিরিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী যদি চায়, কিছুক্ষণের মধ্যই এটা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর বাবার স্বপ্ন ছিল একটি সোনার বাংলাদেশ গড়ার। সে দেশে নিশ্চয়ই গুমের মতো জঘন্য অপরাধ হতো না।’
মামলার কাগজপত্র খুঁজে দেখা যায়, মাছ ব্যবসায়ী ইমাম মেহেদী হাসানের সন্ধান চেয়ে গত বছরের ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে আইনি ব্যবস্থা চেয়ে আবেদন করেন তার স্ত্রী। একই তারিখে বাংলাদেশ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) ডাইরেক্টর জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মামুন (অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) বরাবার লিখিত আবেদন করেন তিনি।
ইমাম মেহেদী হাসানের পক্ষের আইনজীবী সারওয়ার হোসেন দাবি করেন, এ গুমের সাথে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই শুধু নয়, বৈদেশিক কোনো দেশও জড়িত থাকতে পারে।
এ বিষয়ে মানবধিকার কর্মী নূর খান লিটন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ইমাম মেহেদী হাসান ডলারকে গ্রেপ্তারের দুই দিন পর তার ফোন ট্যাগ করে জানা যায়, তার অবস্থান ঢাকার উত্তরা র্যাব হেড কোয়াটার্সের আশেপাশে। এমন ঘটনা আমরা আগেও দেখেছি। দেশের বর্তমান অবস্থা হলো- সংবিধান কিংবা আইন বইয়ের মধ্যেই রয়েছে, বাস্তবে নেই। আমরা কেন জাতি হিসেবে এতটা অসহায় হয়ে গেছি, প্রতিটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইতে হবে?’
এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, ‘গত এক মাস আগে র্যাবের একটি দল ইমাম মেহেদী হাসান ডলাররের বাসায় আসে। প্রতিনিধি দল ইংরেজিতে লেখা একটি পত্র নিয়ে আসে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের স্বাক্ষর নিতে চেয়েছে। বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী হলেও তো ইংরেজিতে কোনো পত্র নিয়ে আসার কথা না, বাংলায় হবে। যদিও তার পরিবার স্বাক্ষর করেনি।’

ইমাম মেহেদী হাসান ডলার নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর হওয়া তার ব্যবহার করা মোবাইল (আই ফোন) ট্যাগের স্কিনশর্ট এসেছে ঢাকা মেইলের হাতে। যেখানে দেখা যায়, সবশেষ তার স্থান ঢাকার উত্তরা (র্যাব হেডকোয়াটার্স) আশেপাশে।
এ বিষয়ে ইমাম মেহেদী হাসান ডলারের ছোট ভাই রিজভী আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ভাইয়ের ব্যবহার করা ফোনটি ছিল আইফোন। যেটার পাসওয়ার্ড খোলা কঠিন। ভাবিকে বলার পর অনেক খোঁজ নিয়ে ভাইয়ের পার্সনাল ডাইরিতে পাসওয়ার্ড পেয়ে যাই। ভাইকে আটক করার পর থেকে ফোনটি বন্ধ ছিল। সবশেষ লোকেশন আমরা পাই ঢাকার উত্তরা।’
পরিবার সূত্রে জানা যায় ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে মসজিদ কমিটির ঝামেলা হয়। এ নিয়ে র্যাব ডলারসহ এলাকার কয়েজনকে রাতে বাসা থেকে নিয়ে যায়। পরে তাদের নামে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত হওয়ার মামলা দেওয়া হয়। তবে সে মামলায় হাইকোর্ট থেমে জামিন নেন তিনি।
ডিএইচডি/জেবি

