রাজধানীর মহাখালীর আমতলী থেকে গুলশান-১ পর্যন্ত সড়কটি বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়ক হিসেবে পরিচিত। মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আমতলী অংশে প্রবেশ করতেই যে কারো চোখ আটকে যেত সড়কটিতে। কারণ সড়কের বিভাজকে থাকা হরেক রকম গাছ- কৃষ্ণচূড়া, বটসহ সবুজ ডানা বিছিয়ে থাকা ডাল-পাতা। কিন্তু এই সড়কটির বিভাজক উন্নয়নের নামে ছায়াদানকারী শতাধিক গাছ ইতিমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। পরিবেশবাদী ও স্থানীয়রা বলছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) পরিকল্পিতভাবেই দীর্ঘসময় নিয়ে গাছগুলো কেটেছে। অথচ নিজেকে ‘বৃক্ষপ্রেমিক’ দাবি করে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন, ‘যদি কেউ গাছ কাটে, আমি তার হাত কেটে দেব।’
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা বলছেন, সড়কটির ৬০টির বেশি গাছ কাটা হয়েছে প্রায় ২ মাস আগে, যেন উন্নয়ন প্রকল্প চলাকালে গাছ কম কাটতে হয়, যেন কারো দৃষ্টিগোচর না হয়। কাটাপড়া গাছগুলোর অধিকাংশই বড়। অন্যদিকে বর্তমানে কাজ চলমান থাকায় গাছগুলোর গোড়ার অংশের মাটি সরাতে হচ্ছে। কোনো কোনো গাছের শিকড়সহ মূল কাটা পড়ছে। ফলে গাছগুলো হেলে পড়ার অজুহাত দেখিয়ে কাটা হচ্ছে। উন্নয়ন কাজ যত এগিয়ে যাচ্ছে তত বেশি গাছ কাটা পড়ছে। সবমিলিয়ে ১শর বেশি গাছ কাটা পড়েছে। আরও বেশ কিছু গাছ কাটা পড়বে।
সম্প্রতি সরেজমিনে বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সড়কটির বিভাজক বা আইল্যান্ডের উন্নয়ন কাজ চলছে। মহাখালী আমতলী অংশ থেকে শুরু করে গুলশান লিংক রোড পর্যন্ত স্থানভেদে কাটা পড়েছে গাছ। কোথাও কোথাও আবার গাছ রেখেই কাজ চলছে। ব্র্যাক সেন্টারের অদূরে পারটেক্স গ্রুপের অফিসের সামনের সড়ক বিভাজকে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটি কাটা হয়েছে গত সপ্তাহে। স্থানটিতে থাকা গাছের গোড়ালির তাজা অংশই তা বলে দিচ্ছে। কিছু গাছ কাটা হয়েছে বেশকিছু দিন আগে। কাটা পড়া গাছের গোড়ালি থেকে বের হয়েছে সবুজ শাখা-প্রশাখা। কিছু কিছু গাছের শেকড় কাটা পড়ায় পাতা শুকিয়ে গেছে। এছাড়া সড়ক বিভাজক বা আইল্যান্ডের খোঁড়াখুঁড়িতে হেলে পড়তেও দেখা গেছে বেশকিছু গাছ। সেগুলো সরাতেও দেখা গেছে শ্রমিকদের।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা আরও বলছেন, গাছগুলোর অধিকাংশ কাটা হয়েছে রাতের আঁধারে। অপসারণ করাও হয় দ্রুত সময়ে।
সম্প্রতি ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম গাছ কাটার বিপক্ষে তার অবস্থান জানিয়ে বলেছিলেন, আমরা বুঝতে পারছি যে কি হিটের (গরম/তাপদাহ) মধ্যে আছি। তাই পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় দুই লাখ গাছ লাগাব। এর জন্য নগরবাসীর সাহায্য ও সহযোগিতা চাই। আর নগরের যে খালগুলো দখল হয়ে গেছে সেগুলো উদ্ধার করে পানি প্রবাহ করার চেষ্টা করছি। গাছ ও পানির প্রবাহ- তবেই ন্যাচার বেজ সলিউশনে আমরা নগরকে ঠাণ্ডা রাখতে পারি।
উত্তরা-৪ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির মাঠ ও সড়কের চারপাশে দেখিয়ে মেয়র আতিক বলেছিলেন, এই গাছগুলো কাটার প্রক্রিয়ায় ছিল। কিন্তু আমি রাস্তা বড় করেছি, গাছ কাটিনি। গাছ না কেটে গাছের মাঝের জায়গায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই পরিবেশ বাঁচাতে হলে গাছ লাগাতে হবে। আর যদি কেউ গাছ কাটে, তবে আমি তার হাত কেটে দেব- এটা আমার মেসেজ।
অন্যদিকে নগরীর তাপ কমাতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাথে ‘চিফ হিট অফিসার’ হিসেবে কাজ করবেন মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে বুশরা আফরিন। এশিয়ার প্রথম শহর হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটিতে চিফ হিট অফিসার (সিএইচও) হিসেবে কেউ কাজ করবেন।
বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কের পারটেক্স গ্রুপের নিরাপত্তা প্রহরী আব্দুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, গাত ২৬ তারিখ কৃষ্ণচূড়া গাছটি কাটা হয়েছে। ভেকু মেশিন দিয়ে চারপাশের মাটি সরিয়ে ফেলায় গাছটি হেলে যায়। একপর্যায়ে গাছটি কাটা হয়। বাকি সবগুলো গাছ দুই মাস আগে কাটা হয়েছে।
পরিবেশ ও জলবায়ু কর্মী নয়ন সরকার বলেন, মহাখালী টু লিংক রোড গাছ কাটার ক্ষেত্রে দুই নীতি দেখছি। কোথাও কোথাও গাছ কেটে উন্নয়ন করা হচ্ছে। আবার গাছ রেখেও কাজ চলমান রাখছেন তারা। সড়কটির গাছ পরিকল্পিতভাবে ‘হত্যা’র বিচার চেয়ে এ পরিবেশ কর্মী বলেন, গাছ কাটা বন্ধের দাবি জানাই। এতগুলো গাছ কেন কাটা হলো ডিএনসিসির কাছে জবাব চাই। আসলে ডিএনসিসির মেয়র মিডিয়ায় যেমন করে ২ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দেন, আবার কেউ গাছ কাটলে তার হাত কেটে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি এখন কি মিডিয়ায় আবার বলবেন যে এবার তিনি কার হাত কাটবেন? কেন না সড়ক বিভাজক উন্নয়নের নামে অনেকগুলো গাছ কাটা হয়েছে এবং আরও কতগুলোকে কাটা না হলেও মরে লাল হয়ে গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়কের সড়কের পর উত্তর সিটিতে এমন গাছ টাকা নিয়ে সর্বমহলে চলছে তীব্র সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অনেকেই।
গাছের ছবি দিয়ে সাইফুর আলম শোভন নামে একজন লিখেছেন, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কি সুন্দর সেজেছে কৃষ্ণচূড়া গাছটি। এ বর্ষাই শেষ বর্ষা এই কৃষ্ণচূড়া গাছটির জন্য। মেয়র আতিকুলের গাছ উপড়ে ফেলার গাড়ি এসে ঠেকেছে গাছের গুড়িতে। ধানমন্ডিতে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়েছে গাছ রক্ষার জন্য। গুলশান-মহাখালীতে কি কেউ আছে গাছের পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়রের দানব যানটাকে রুখে দেবে? কেউ কি উত্তরের চিফ হিট অফিসারকে তথ্যটা পৌঁছে দিতে পারেন।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) সদস্য সচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশের নগর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত। মগবাজারের ফ্লাইওভারের নিচে পিলারে সিটি করপোরেশন লিখেছে গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান। স্বার্থান্বেষী মহলের ধান্দাই হলো মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা।
আনোয়ারুল হক বলেন, উন্নয়নের নামে এই শহরের যেকোনো গাছ কাটা ও লাগানোর আগে উদ্ভিদবিদদের পরামর্শ নেয়া জরুরি। শহরের মানুষগুলোর বাঁচার স্বার্থে গাছ না কেটে আরও বেশি দেশীয় গাছ রোপন করা প্রয়োজন বলেও মত তার।
এদিকে ধানমন্ডি, গুলশানসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গাছ কাটার বিরুদ্ধে আজ মঙ্গলবার বিকালে ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের বিপরীত দিকে পারফরম্যান্স আর্টিস্টদের অংশগ্রহণে এক শৈল্পিক পরিবেশনার আয়োজন করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা ঢাকা মেইলকে বলেন, আইল্যান্ডের কাজ করতে গিয়ে হয়তো কিছু গাছ হেলে পড়েছিল, ঝুলে পড়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সবসময় গাছ কাটার বিপক্ষে। সিটি করপোরেশন এরিয়ায় ২ লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কিছু সড়ক ঠিক করা হয়েছে। যেখানে বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কও রয়েছে। সড়কটিকে সবুজায়নের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। শিগগিরই কাজটি শুরু হবে বলে আশা করছি। তখন এ সড়কটিও সবুজায়ন হবে ইনশাআল্লাহ।
সম্প্রতি ব্র্যাক সেন্টারসহ তিতুমীর কলেজের সামনের একাধিক স্থানে গাছ কাটার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাস্তাটির উন্নয়ন করতে গিয়ে হয়তো ২-১টা গাছ হেলে গিয়েছিল বা পড়ে গিয়েছিল, এমনটা হতে পারে। মেয়র মহোদয় এবং আমরা অর্ডার দিয়ে দিয়েছি, কোনো রাস্তায় গাছ কেটে উন্নয়ন আমরা করব না। একটি গাছ কাটলে দুইটা গাছ লাগাও- এ নীতিতে আমরা নেই। আমরা বলেছি, কোনো গাছই কাটা যাবে না। মাঝেমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে গাছ পড়ে যাচ্ছে, কোথাও কোথাও গাছ মরে যাচ্ছে, সেগুলো আমাদের অপসারণ করতে হচ্ছে। দায়িত্ব নিয়ে গাছ গেটে রাস্তা বানানোর চিন্তা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কখনোই নেই।
ডিএইচডি