আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ। প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, জাগরণের কবি, চেতনার কবি, মুল্যবোধের কবি, সাম্যের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের ২৪ মে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ। মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। তিনি ছিলেন পিতামাতার ৬ষ্ঠ সন্তান। তার ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া।
১৯০৮ সালে কাজী নজরুল ইসলামের পিতা ফকির আহমদ মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরিবার আর্থিক অনটন ও কষ্টের মধ্যে পড়ে যায়। গ্রামের স্থানীয় মক্তবে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের প্রয়োজনে নজরুল নিজের মক্তবে শিক্ষকতা ও মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। আল কুরআন, ধর্ম ও দর্শন, ইসলামী জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশের সুযোগ পান তিনি বাল্যকালেই। পরবর্তীকালে এই অর্জন তার সাহিত্যকর্মে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। আরবি, উর্দু, ফারসি ভাষার জ্ঞান তাকে এক অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তার অবিনাশী চেতনা মানুষের মনে সাহসের সৃষ্টি করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় আচরণ ও শোষণের মনোভাব তার স্বাধীন চেতনাকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। নজরুল ছিলেন সব নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। দুঃখ-কষ্টে দিনযাপনকারী নজরুল সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়ে গেছেন। একদিকে শাসকের রক্তচক্ষু, অন্যদিকে শোষকের প্ররোচনার বিরুদ্ধে সারাজীবন কলম চালিয়ে গেছেন। কূপমন্ডুক ভণ্ড প্রতারকরা নজরুলকে একদণ্ড স্থির থাকতে দেয়নি। অনটন তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কিন্তু তাকে দমাতে পারেনি। নজরুল তাই শুধু একজন কবি নন। হয়ে উঠেছেন এক চেতনার নাম। কবি অসংখ্য মানুষের আলোর পথের পথিক। অবিনাশী চেতনার ধারক।
বিজ্ঞাপন
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। তিনি মক্তবে শিক্ষকতা যেমন করেছেন ঠিক তেমনি হোটেল কর্মচারি, রুটির দোকানের ম্যানেজার এবং ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে হাবিলদার হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। এসব জায়গাতেই তার কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। তিনি সর্বত্রই লেখালেখি গানবাজনা রচনা ও কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। তিনি বাল্যকালে লেটোর দলে যুক্ত হন। নাটক পরিচালনা করেন। এসব কাজ তার বহুমাত্রিক গুণ বিকাশে সহায়তা করে। করাচি সেনানিবাসে চাকুরিকালীন তিনি পাঞ্জাবি মৌলবীর কাছে ফার্সি ভাষা শিক্ষার সুযোগ পান। সেখানে তিনি সৈনিক জীবনের পাশাপাশি গল্প-কবিতা চর্চা করতে থাকেন। ১৯২০ সালে সৈনিক জীবন সমাপ্ত করে নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন এবং কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতায় সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি নজরুল সাংবাদিকতা শুরু করেন। কলকাতায় সওগাত অফিসে নাসিরউদ্দিনের সাথে পরিচয় ঘটে। সেখানে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের সাথেও তার পরিচয় ঘটে। অন্যদিকে অতুলপ্রসাদ সেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, হেমন্তকুমার রায় প্রমুখের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তৎকালীন কমিউনিষ্ট নেতা মুজাফফর আহমদের সাথে নজরুলের ছিল অসম্ভব রকম বন্ধুত্ব। নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার অনেকটাই মুজাফফর আহমদের প্রভাবে হলেও তিনি কখনোই কমিউনিষ্ট পার্টির সভ্য হননি। তুর্কি বীর মোস্তফা কামাল পাশার ভীষণ ভক্ত ছিলেন তিনি। নজরুল লেখেন, ‘ওই ক্ষেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, অসুরপুরে সুর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই। কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই।’
তিনি নবযুগ, লাঙ্গল এবং সওগাতে সাংবাদিকতা করেছেন।
১৯২১ সালে নজরুল কুমিল্লায় আসেন এবং সেখানকার আলী আকবর খানের ভগ্নি নার্গিস আসার খানমের সাথে তার আকদ হয়। কিন্তু রাতেই নজরুল সেখান থেকে চলে যান। নজরুল জীবনের এই অংশ নিয়ে নানান রকম বক্তব্য প্রচলিত আছে। অনেকের মতে তাকে ঘরজামাই থাকার শর্ত দিলে স্বাধীনচেতা নজরুল কাউকে না বলে চলে যান। নার্গিসের সাথে তার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি আজো এক রহস্য। নজরুলের জীবনে নার্গিসের প্রভাব ছিল। তিনি এ নিয়ে গানও লিখেছেন। আলী আকবর খানের বাড়ি থেকে চলে যাবার পর তিনি প্রমীলাদের বাড়িতে ওঠেন। সেদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। প্রমীলার পরিচর্যায় তিনি সুস্থ হন এবং পরে তিনি প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন।
নজরুল ছিলেন বিদ্রোহের কবি। তার প্রতিটি কাব্য ছিল বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ভরপুর। তিনি লিখেছেন, ‘এদেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে তোদের কিলের চোটে হাড় করিব জল।’ তার অবিনাশী চেতনা ফুটে ওঠে- ‘বল বীর,বল উন্নত মমশির। শির নেহারি, আমারই নত শির, ওই শিখর হিমাদ্রির’ এই কবিতার মাঝে। তিনি লিখেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতুর্য।’ ‘আমি সেইদিন হব শান্ত। যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।’
বিজ্ঞাপন
নজরুলের কাব্যচর্চার সময়কাল দীর্ঘ নয়। ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বাকশক্তি রহিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসায় তার আরোগ্যলাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কবি পরিবার কলকাতায় নিভৃতে জীবনযাপন করেন। ১৯৫৩ সালে নজরুল ও তার প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা নজরুলের চিকিৎসায় একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং দুজনকেই লন্ডন পাঠানো হয়। লন্ডনের খ্যাতনামা চিকিৎসকরা অভিমত দেন তিনি স্নায়বিক যে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তা দূরারোগ্য। শুরুতেই এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব ছিল বলেও তারা মত দেন। ফলে তাকে আবার দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
নজরুলের গান, কবিতা, গজল, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ- প্রতিটি কর্মই অনবদ্য। তার সৃষ্টিশীল লেখনি যুগ যুগ ধরে বাংলাভাষী সাহিত্য অনুরাগী সঙ্গীতপিপাসুদের প্রেরণা জোগাবে। নজরুল সবচেয়ে বেশি লিখেছেন গান। সঙ্গীতেই তার সৃষ্টিশীলতা বিকশিত হয়েছে। তিনি সাড়ে চার হাজারের বেশি সঙ্গীত রচনা করেছেন। এরমধ্যে প্রেমের গান, দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, শ্যামাসঙ্গীত যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে ইসলামী সঙ্গীত। তার প্রতিটি ভক্তিমূলক ইসলামী গানই কালোত্তীর্ণ। মুসলমান সমাজের দৈন্যতা নিয়ে তিনি যেমন লিখেছেন তেমনি লিখেছেন হামদ ও নাতে রসূল সা.। তার ইসলামী সঙ্গীতের মধ্যে নাতে রাসূলের সা. সংখ্যাই বেশি। তার রচিত ইসলামী সঙ্গীত এতটা ভাবাবেগপূর্ণ যে তা বিশ্বাসীদের হৃদয় স্পর্শ করে। হৃদয়ের তন্ত্রিতে শিহরণ জাগায়। নজরুল লিখেছেন, ‘খোদারই প্রেমের শরাব পিয়ে, বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে।’ আবার লিখেছেন, ‘খোদা এই গরিবের শোন শোন মোনাজাত, দিও তৃষ্ণা পেলে ঠান্ডা পানি ক্ষুধা পেলে লবণ ভাত।’ তার লেখায় নবী প্রশস্তি ফুটে উঠেছে এভাবে: ‘মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, তাই কিরে তোর কণ্ঠেরই গান এতই মধুর লাগে।’ ‘আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ। যেই পথে মোর চলে যেতেন নূরনবী হযরত।’ ‘সুদূর মক্কা-মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির।’ চিরন্তন প্রেমের কাহিনী লিখেছেন এভাবে, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল।’ আবার বলেছেন, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ।’ ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোলো।’ ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না ওই নয়ন পানে।’ দেশবাসীকে কখনো কবি সতর্ক করেছেন এই বলে, ‘দুর্গম গিরি কান্তর মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’ মুসলমান সমাজকে উদ্দেশ্য করে নজরুল লিখেছেন, ‘জাগে না সে জোশ লয়ে আর মুসলমান।’
নজরুল ছিলেন সাম্প্রদায়িক ভেদমুক্ত একজন স্বাধীনচেতা কবি। পাশাপাশি নিজ ধর্মের প্রতি ভীষণ অনুরাগী একজন বিশ্বাসী মানুষ। তিনি সমাজের সব অসঙ্গতি প্রথা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন। তিনি প্রতিবাদী কবি হওয়ায় কারাগারে গেছেন। উপমহাদেশের বংলাভাষী মানুষের কাছে তাই তিনি সম্মান মর্যাদা ও গৌরবের আলাদা আসন লাভ করেছেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় আনা হয়। বঙ্গবন্ধু তার সুচিকিৎসা ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেন। তাকে রাখা হয় ধানমন্ডির কবিভবনে। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে কবির নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অন্যান্য চিকিৎসা চলতে থাকে। ১৯৭৬ সালে কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। এ বছরেরই ২৯ আগস্ট তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার অমর গান ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’- এ কথা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। সেখানেই আজো ঘুমিয়ে আছেন বাংলার গানের এই বুলবুলি।
একে